পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

놀이O গল্পগুচ্ছ সেখানে অন্ধকার আরও ঘনীভূত; যতটুকু আকাশ দেখা যাইতেছে একেবারে তারায় আচ্ছন্ন ; তরতলের ঝিল্লিধৰনি যেন অনন্তগগনবক্ষচু্যত নিঃশব্দতার নিম্নপ্রান্তে একটি শব্দের সর পাড় বনিয়া দিতেছে। সেদিনও বৈকালে আমি কিছ মদ খাইয়ছিলাম, মনটা বেশ একটা তরলাবস্থায় ছিল। অন্ধকার যখন চোখে সহিয়া আসিল তখন বনচ্ছায়াতলে পান্ডুর বণে অঙ্কিত সেই শিথিল-অঞ্চল শ্রান্তকায় রমণীর আবছায়া মতিটি আমার মনে এক অনিবায" আবেগের সঞ্চার করিল। মনে হইল, ও যেন একটি ছয়া, ওকে যেন কিছুতেই দুই বাহ দিয়া ধরিতে পারিব না। এমনসময় অন্ধকার ঝাউগাছের শিখরদেশে যেন আগন ধরিয়া উঠিল; তাহার পরে কৃষ্ণপক্ষের জীণ প্রান্ত হলদেবণ চাঁদ ধীরে ধীরে গাছের মাথার উপরকার আকাশে আরোহণ করিল ; সাদা পাথরের উপর সাদা শাড়ি-পরা সেই শ্রাতশয়ন রমণীর মুখের উপর জ্যোৎসনা আসিয়া পড়িল । আমি আর থাকিতে পারিলাম না। কাছে আসিয়া দই হাতে তাহার হাতটি তুলিয়া ধরিয়া কহিলাম, "মনোরমা, তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না, কিন্তু তোমাকে আমি ভালোবাসি। তোমাকে আমি কোনো কালে ভুলিতে পারিব না।” কথাটা বলিবামাত্র চমকিয়া উঠিলাম ; মনে পড়িল, ঠিক এই কথাটা আর-একদিন আর-কাহাকেও বলিয়াছি! এবং সেই মহেতেই বকুলগাছের শাখার উপর দিয়া, ঝাউগাছের মাথার উপর দিয়া, কৃষ্ণপক্ষের পীতবণ ভঙা চাঁদের নীচ দিয়া, গঙ্গার পবপার হইতে গঙ্গার সদর পশ্চিমপার পর্যন্ত হাহা—হাহা-হাহা করিয়া অতি দ্রুতবেগে একটা হাসি বহিয়া গেল। সেটা মমভেদী হাসি কি অভ্ৰভেদী হাহাকার, বলিতে পারি না। আমি তদন্ডেই পাথরের বেদীর উপর হইতে মুছিত হইয়া নীচে পড়িয়া গেলাম । মছাভঙ্গে দেখিলাম, আমার ঘরে বিছানায় শক্টয়া আছি। সত্ৰী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার হঠাৎ এমন হইল কেন।” আমি কাঁপিয়া উঠিয়া বলিলাম, “শুনিতে পাও নাই সমস্ত আকাশ ভরিয়া হাহ করিয়া একটা হাসি বহিয়া গেল ?” সন্ত্রী হাসিয়া কহিলেন, “সে বুঝি হাসি ? সার বধিয়া দীঘ একঝাঁক পাখি উড়িয়া গেল, তাহাদেরই পাখার শব্দ শুনিয়াছিলাম। তুমি এত অপেই ভয় পাও ?” দিনের বেলায় পল্ট বুঝিতে পারিলাম, পাখির ঝকি উড়িবার শব্দই বটে, এই সময়ে উত্তরদেশ হইতে হংসশ্রেণী নদীর চরে চরিবার জন্য আসিতেছে। কিন্তু সন্ধ্যা হইলে সে বিশ্বাস রাখিতে পারিতাম না । তখন মনে হইত, চরি দিকে সমস্ত অন্ধকার ভরিয়া ঘন হাসি জমা হইয়া রহিয়াছে, সামান্য একটা উপলক্ষ্যে হঠাৎ আকাশ ভরিয়া অঙ্গধকার বিদীণ করিয়া ধৰনিত হইয়া উঠিবে। অবশেষে এমন হইল, সন্ধ্যার পর মনোরমার সহিত একটা কথা বলিতে আমার সাহস হইত না। তখন আমাদের বরানগরের বাড়ি ছড়িয়া মনোরমাকে লইয়া বোটে করিয়া বাহির হইলাম। অগ্রহায়ণ মাসে নদীর বাতাসে সমস্ত ভয় চলিয়া গেল। কয়দিন বড়ো সখে ছিলাম। চারি দিকের সৌন্দযে আকৃষ্ট হইয়া মনোরমাও যেন তাহার হাদয়ের রথে প্ৰায় অনেক দিন পরে ধীরে ধীরে আমার নিকট খলিতে লাগিল।