পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নিশীথে ՀԳֆ গঙ্গা ছাড়াইয়া, খড়ে ছাড়াইয়া, অবশেষে পামায় আসিয়া পৌছিলাম। ভয়ংকরী পদ্মা তখন হেমন্তের বিবরলীন ভুজঙ্গিনীর মতো কৃশনিজীবিভাবে সন্দীঘ শীতনিদ্রায় নিবিষ্ট ছিল। উত্তরপারে জনশন্য তৃণশন্য দিগন্তপ্রসারিত বালির চর ধন ধন করিতেছে, এবং দক্ষিণের উচ্চ পাড়ের উপর গ্রামের আমবাগানগুলি এই রাক্ষসী নদীর নিতান্ত মুখের কাছে জোড়হন্তে দাঁড়াইয়া কপিতেছে; পদ্মা ঘমের ঘোরে এক-একবার পাশ ফিরিতেছে এবং বিদীণ তটভূমি ঝাপঝাপ করিয়া ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়িতেছে। এইখানে বেড়াইবার সুবিধা দেখিয়া বোট বধিলাম । একদিন আমরা দুইজনে বেড়াইতে বেড়াইতে বহু দরে চলিয়া গেলাম। সযাস্তের বর্ণচ্ছায়া মিলাইয়া যাইতেই শুক্লপক্ষের নিমলি চন্দ্রালোক দেখিতে দেখিতে ফুটিয়া উঠিল। সেই অন্তহীন শত্র বালির চরের উপর যখন অজস্র অবারিত উচ্ছসিত জ্যোৎসনা একেবারে আকাশের সীমান্ত পর্যন্ত প্রসারিত হইয়া গেল, তখন মনে হইল যেন জনশন্য চন্দ্রলোকের অসীম সবগুনরাজ্যের মধ্যে কেবল আমরা দুইজনে ভ্রমণ করিতেছি । একটি লাল শাল মনোরমার মাথার উপর হইতে নামিয়া তাহার মুখখানি বেস্টন করিয়া তাহার শরীরটি আচ্ছন্ন করিয়া রহিয়াছে। নিস্তব্ধতা যখন নিবিড় হইয়া আসিল, কেবল একটি সীমাহীন দিশাহীন শত্রতা এবং শন্যতা ছাড়া যখন আর কিছুই রহিল না, তখন মনোরমা ধীরে ধীরে হাতটি বাহির করিয়া আমার হাত চাপিয়া ধরিল ; অত্যন্ত কাছে আসিয়া সে যেন তাহার সমস্ত শরীরমন জীবনযৌবন আমার উপর বিন্যস্ত করিয়া নিতান্ত নিভাঁর করিয়া দাঁড়াইল। পলকিত উদবেলিত হৃদয়ে মনে করিলাম, ঘরের মধ্যে কি যথেষ্ট ভালোবাসা যায়। এইরুপ অনাবত অবারিত অনন্ত আকাশ নহিলে কি দুটি মানুষকে কোথাও ধরে। তখন মনে হইল, আমাদের ঘর নাই, বার নাই, কোথাও ফিরিবার নাই, এমনি করিয়া হাতে হাতে ধরিয়া গম্যহীন পথে উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণে চন্দ্রালোকিত শুন্যতার উপর দিয়া অবারিতভাবে চলিয়া যাইব । এইরুপে চলিতে চলিতে এক জায়গায় আসিয়া দেখিলাম, সেই বালকোরাশির মাঝখানে অদরে একটি জলাশয়ের মতো হইয়াছে— পদ্মা সরিয়া যাওয়ার পর সেইখানে জল বাধিয়া আছে । সেই মরবালকে বেষ্টিত নিস্তরঙ্গ নিষপত নিশ্চল জলট কুর উপরে একটি সাদীঘ' জ্যোৎস্নার রেখা মছি"তভাবে পড়িয়া আছে। সেই জায়গাটাতে আসিয়া আমরা দুইজনে দাঁড়াইলাম— মনোরমা কী ভাবিয়া আমার মুখের দিকে চাহিল, তাহার মাথার উপর হইতে শালটা হঠাৎ খসিয়া পড়িল । আমি তাহার সেই জ্যোৎস্নাবিকশিত মনখখানি তুলিয়া ধরিয়া চুম্বন করিলাম। এমন সময় সেই জনমানবশতন্য নিঃসঙ্গ মরভূমির মধ্যে গভীরত্বরে কে তিনবার বলিয়া উঠিল, “ও কে । ও কে। ও কে ।” আমি চমকিয়া উঠিলাম, আমার স্মীও কাঁপিয়া উঠিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই আমরা দুইজনেই বুঝিলাম, এই শব্দ মানষিক নহে, অমানষিকও নহে—চরবিহারী জলচর পাখির ডাক। হঠাৎ এত রাত্রে তাহাদের নিরাপদ নিভৃত নিবাসের কাছে লোকসমাগম দেখিয়া চকিত হইয়া উঠিয়াছে। সেই ভয়ের চমক খাইয়া আমরা দুইজনেই তাড়াতাড়ি বোটে ফিরিলাম। রাতে