পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

이b গল্পগুচ্ছ ডাকিয়া না খাওয়াইলে তাহার বক্ষ ব্যথিত, তাহার মুখ বিস্বাদ হইয়া উঠিত, না খাইয়া উঠিয়া পড়িত; বাৎপর্যন্ধকণ্ঠে দাসীকে বলিয়া যাইত "আমার ক্ষধা নাই"। মনে করিত, কিরণ সংবাদ পাইয়া এখনি অনন্তপ্তচিত্তে তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইবেন এবং খাইবার জন্য বারবার অনুরোধ করিবেন, সে তথাপি কিছুতেই সে অনুরোধ পালন করিবে না, বলিবে “আমার ক্ষুধা নাই”। কিন্তু কিরণকে কেহ সংবাদও দেয় না, কিরণ তাহাকে ডাকিয়াও পাঠান না; খাবার যাহা থাকে দাসী খাইয়া ফেলে। তখন সে আপন শয়নগহের প্রদীপ নিবাইয়া দিয়া অন্ধকার বিছানার উপর পড়িয়া ফলিয়াফলিয়া ফাঁপিয়া-ফপিয়া মুখের উপর সবলে বালিশ চাপিয়া ধরিয়া কাঁদিতে থাকে: কিন্তু কী তাহার নালিশ, কাহার উপরে তাহার দাবি, কে তাহকে সাত্বন করিতে আসিবে! যখন কেহই আসে না, তখন স্নেহময়ী বিশ্ববধাত্রী নিদ্র অসিয়া ধীরে ধীরে কোমলকরপশে এই মাতৃহীন ব্যথিত বালকের অভিমান শান্ত করিয়া দেন । নীলকান্তের দঢ় ধারণা হইল, সতীশ কিরণের কাছে তাহার নামে সবদাই লাগায় ; যেদিন কিরণ কোনো কারণে গম্ভীর হইয়া থাকিতেন সেদিন নীলকান্ত মনে করিত, সতীশের চক্রান্তে কিরণ তাহারই উপর রাগ করিয়া আছেন। এখন হইতে নীলকান্ত একমনে তীব্র আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সবদাই দেবতার নিকট প্রার্থনা করে, “আর-জন্মে আমি যেন সতীশ হই এবং সতীশ যেন আমি হয় ।” সে জানিত, ব্রাহণের একান্ত মনের অভিশাপ কখনও নিফল হয় না, এইজন্য সে মনে মনে সতীশকে ব্রহয়তেজে দগধ করিতে গিয়া নিজে দগ্ধ হইতে থাকিত, এবং উপরের তলা হইতে সতীশ ও তাহার বউঠাকুরানীর উচ্ছসিত উচ্চহাস্যমিশ্রিত পরিহাসকলরব শুনিতে পাইত। নীলকান্ত পষ্টত সতীশের কোনোরপে শত্রতা করিতে সাহস করিত না, কিন্তু সযোগমত তাহার ছোটোখাটো অসুবিধা ঘটাইয়া প্রীতিলাভ করিত। ঘাটের সোপানে সাবান রাখিয়া সতীশ যখন গঙ্গায় নামিয়া ডুব দিতে আরম্ভ করিত তখন নীলকান্ত ফস করিয়া আসিয়া সাবান চুরি করিয়া লইত সতীশ যথাকলে সবনের সন্ধানে আসিয়া দেখিত, সাবান নাই। একদিন নাহিতে নাহিতে হঠাৎ দেখিল তাহার বিশেষ শখের চিকনের-কাজ-করা জামাটি গঙ্গার জলে ভাসিযা যাইতেছে ; ভবিল, হাওয়ার উড়িয়া গেছে, কিন্তু হাওয়াটা কোন দিক হইতে বহিল তাহা কেহ জানে না। একদিন সতীশকে আমোদ দিবার জন্য কিরণ নীলকান্তকে ডাকিয়া তাহাকে যাত্রার গান গাহিতে বলিলেন; নীলকান্ত নিরক্তের হইয়া রহিল। কিরণ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোর আবার কী হল রে।” নীলকান্ত তাহার জবাব দিল না। কিরণ পনশ্চ বলিলেন, “সেই গানটা গা-না।” “সে আমি ভুলে গেছি” বলিয়া নীলকান্ত চলিয়া গেল । অবশেষে কিরণের দেশে ফিরিবার সময় হইল। সকলেই প্রস্তুত হইতে লাগিল: সতীশও সঙ্গে যাইবে । কিন্তু নীলকান্তকে কেহ কোনো কথাই বলে না। সে সঙ্গে যাইবে কি থাকিবে, সে প্রশ্নমার কাহারও মনে উদয় হয় না। কিরণ নীলকান্তকে সঙ্গে লইবার প্রস্তাব করিলেন। তাহাতে শাশুড়ি স্বামী এবং দেবর সকলেই একবাক্যে আপত্তি করিয়া উঠিলেন, কিরণ তাঁহার সংকল্প ত্যাগ করিলেন। অবশেষে যাত্রার দই দিন আগে ব্রাহরণবালককে ডাকিয়া কিরণ তাহাকে