পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আপদ স্নেহবাক্যে সবদেশে যাইতে উপদেশ করিলেন । সে উপরি উপরি কয়দিন অবহেলার পর মিষ্টবাক্য শুনিতে পাইয়া আর থাকিতে পারিল না, একেবারে কাঁদিয়া উঠিল। কিরণেরও চোখ ছল ছল করিয়া উঠিল; যাহাকে চিরকাল কাছে রাখা যাইবে না তাহাকে কিছুদিন আদর দিয়া তাহার মায়া বসিতে দেওয়া ভালো হয় নাই বলিয়া কিরণের মনে বড়ো অনুতাপ উপস্থিত হইল। সতীশ কাছে উপস্থিত ছিল; সে অত বড়ো ছেলের কান্না দেখিয়া ভারি বিরক্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, “আরে মোলো! কথা নাই, বতা নাই, একেবারে কদিয়াই অপিথর !” কিরণ এই কঠোর উক্তির জন্য সতীশকে ভৎসনা করিলেন। সতীশ কহিল, “তুমি বোঝ না বউদিদি, তুমি সকলকেই বড়ো বেশি বিশ্ববাস করো; কোথাকার কে তার ঠিক নাই, এখানে আসিয়া দিব্য রাজার হালে আছে। আবার পনমৰিক হইবার আশংকায় অ জ মায়াকান্না জড়িয়াছে— ও বেশ জানে যে, দুফোঁটা চোখের জল ফেলিলেই তুমি গলিয়া যাইবে।” নীলকান্ত তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল। কিন্তু তাহার মনটা সতাঁশের কাল্পনিক মতিকে ছুরি হইয়া কাটিতে লাগিল, ছাঁচ হইয়া বিধিতে লাগিল, আগন হইয়া জনালাইতে লগিল। কিন্তু প্রকৃত সতীশের গায়ে একটি চিহ্নমাত্র বসিল না, কেবল তাহারই মম'সথল হইতে রক্তপাত হইতে লাগিল । কলিকাতা হইতে সতীশ একটি শৌখিন দেয়াতদান কিনিয়া আনিয়াছিল, তাহাতে দুই পাশে দলই ঝিনুকের নৌকার উপর দেয়াত বসানো এবং মাঝে একটা জমান রৌপ্যের হাঁস উন্মৰ চঞ্চপেটে কলম লইয়া পাখা মেলিয়া বসিয়া আছে; সেটির প্রতি সতীশের অত্যন্ত যত্ন ছিল, প্রায় সে মাঝে মাঝে সিকের রমাল দিয়া অতি সযত্নে সেটি ঝাড় পাঁচ করিত। কিরণ প্রায়ই পরিহাস করিয়া সেই রৌপ্যহংসের চচ্চঅগ্রভাগে অঙ্গুলির আঘাত করিয়া বলিতেন “ওরে রাজহংস, জমি বিজবংশে এমন নশংস কেন হলি রে” এবং ইহাই উপলক্ষ করিয়া দেবরে তাঁহাতে হাস্যকৌতুকের বাগযন্ধে চলিত। স্বদেশবার আগের দিন সকালবেলায় সে জিনিসটা খুজিয়া পাওয়া গেল না। কিরণ হাসিয়া কহিলেন, “ঠাকুরপো, তোমার রাজহংস তোমার দময়ন্তীর অন্বেষণে উড়িয়াছে।” কিন্তু সতীশ অনিশমা হইয়া উঠিল। নীলকান্তই যে সেটা চুরি করিয়াছে সে বিষয়ে তাহার সন্দেহমাত্র রহিল না— গতকলা সন্ধ্যার সময় তাহাকে সতীশের ঘরের কাছে ঘরে ঘরে করিতে দেখিয়াছে, এমন সাক্ষীও পাওয়া গেল। সতীশের সম্মখে অপরাধী আনীত হইল। সেখানে কিরণও উপস্থিত ছিলেন। সতীশ একেবারেই তাহাকে বলিয়া উঠিলেন, “তুই আমার দোয়াত চুরি করে কোথায় রেখেছিস, এনে দে।" নীলকান্ত নানা অপরাধে এবং বিনা অপরাধেও শরতের কাছে অনেক মার খাইয়াছে এবং বরাবর প্রফুল্লচিত্তে তাহা বহন করিয়ছে। কিন্তু কিরণের সম্মুখে যখন তাহার নামে দেয়াত-চুরির অপবাদ আসিল, তখন তাহার বড়ো বড়ো দই চোখ অগানের মতো জনলিতে লাগিল; তাহার বকের কাছটা ফলিয়া কণ্ঠের কাছে ঠেলিয়া উঠিল: