পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

अन्धान्छु... २*¢ করিয়া দিয়া জগতের কেন্দ্রস্থলে বিরাজ করিতে পারে, যেখানে সে অজ্ঞাত অবজ্ঞাত তুচ্ছ সাধারণ নারীমাত্র নহে। এখন হইতে সে প্রতি সপ্তাহেই থিয়েটারে যাইতে আরম্ভ করিল। কালক্রমে, তাহার সেই প্রথম মোহ অনেকটা পরিমাণে হ্রাস হইয়া আসিল— এখন সে নটনটীদের মুখের রঙচঙ, সৌন্দয্যের অভাব, অভিনয়ের কৃত্রিমতা সমস্ত দেখিতে পাইল, কিন্তু তব তাহার নেশা ছটিল না। রণসংগীত শুনিলে যোদ্ধার হদয় যেমন নাচিয়া উঠে, রঙ্গমঞ্চের পট উঠিয়া গেলেই তাহার বক্ষের মধ্যে সেইরাপ আন্দোলন উপস্থিত হইত। ঐ-যে সমস্ত সংসার হইতে স্বতন্ত্র সদশ্য সমক্ষে সন্দের বেদিকা সবণীলেখায় অঙ্কিত, চিত্রপটে সজিত, কাব্য এবং সংগীতের ইন্দ্রজালে মায়ামণ্ডিত, অসংখ্য মপেধদটির বারা আক্ৰান্ত, নেপথ্যভূমির গোপনতার দ্বারা অপবরহস্যপ্রাপ্ত, উক্তজবল আলোকমালায় সবসমক্ষে সম্প্রকাশিত— বিশ্ববিজয়িনী সৌন্দযরাজ্ঞীর পক্ষে এমন মায়াসিংহাসন আর কোথায় আছে । প্রথমে যেদিন সে তাহার স্বামীকে রঙ্গভূমিতে উপস্থিত দেখিল, এবং যখন গোপীনাথ কোনো নটীর অভিনয়ে উন্মত্ত উচ্ছাস প্রকাশ করিতে লাগিল, তখন স্বামীর প্রতি তাহার মনে প্রবল অবজ্ঞার উদয় হইল। সে জজরিতচিত্তে মনে করিল, যদি কখনও এমন দিন আসে যে তাহার স্বামী তাহার রাপে আকৃষ্ট হইয়া দন্ধপক্ষ পতঙ্গের মতো তাহার পদতলে আসিয়া পড়ে, এবং সে আপন চরণনখরের প্রান্ত হইতে উপেক্ষা বিকীর্ণ করিয়া দিয়া অভিমানভরে চলিয়া যাইতে পারে, তবেই তাহর এই ব্যথ" রূপ ব্যথ যৌবন সাথকতা লাভ করিবে । কিন্তু সে শুভদিন আসিল কই । আজকাল গোপীনাথের দশন পাওয়াই দলভ হইয়াছে। সে আপন প্রমত্ততার ঝড়ের মুখে ধালিধনজের মতে একটা দল পাকাইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে কোথায় চলিয়া গিয়াছে তাহার আর ঠিকানা নাই । একদিন চৈত্রমাসের বাসন্তী পণিমায় গিরিবালা বাসন্তী রঙের কাপড় পরিয়া দক্ষিণবাতাসে অঞ্চল উড়াইয়া ছাদের উপর বসিয়া ছিল । যদিও ঘরে স্বামী আসে না তব গিরি উলটিয়া পালটিয়া প্রতিদিন বদল করিয়া নতন নতেন গহনায় আপনাকে সসজিত করিয়া তুলিত । হীবামকুতার আভরণ তাহার অঙ্গে প্রতাঙ্গে একটি উন্মাদনা সঞ্চার করিত, ঝলমল করিয়া রনঝেন বাজিয়া তাহার চারি দিকে একটি হিল্লোল তুলিতে থাকিত । আজ সে হাতে বাজুবন্ধ এবং গলায় একটি চুনি ও মন্তোর কন্ঠী পরিয়াছে এবং বামহস্তের কনিষ্ঠ অঙ্গুলিতে একটি নীলার আংটি দিয়াছে। সধো পায়ের কাছে বসিয়া মাঝে মাঝে তাহার নিটোল কোমল রক্তোৎপলপদপল্লবে হাত বলাইতেছিল এবং অকৃত্রিম উচ্ছাসের সহিত বলিতেছিল, “আহা বউঠাকরন, আমি যদি পরষমানুষ হইতাম তাহা হইলে এই পা দুখানি বকে লইয়া মরিতাম।” গিরিবালা সগবে হাসিয়া উত্তর দিতেছিল, “বোধ করি বকে না লইয়াই মরিতে হইত— তখন কি আর এমন করিয়া পা ছড়াইয়া দিতাম। আর বাঁকস নে । তুই সেই গানটা গা।” সাধো সেই জ্যোৎস্নাপলাবিত নিজন ছাদের উপর গাহিতে লাগিল— দাসখত দিলেম লিখে শ্রীচরণে, সকলে সাক্ষী থাকুক বন্দাবনে।