পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ক্ষধিত পাষাণ ৩২১ পরদিন প্রাতঃকালে সমস্ত ব্যাপারটি পরম হাস্যজনক বলিয়া বোধ হইল। আনন্দমনে সাহেবের মতো সোলা-টপি পরিয়া, নিজের হাতে গাড়ি হাঁকাইয়া, গড় গড় শব্দে আপন তদন্তকাযে চলিয়া গেলাম। সেদিন ত্রৈমাসিক রিপোর্ট লিখিবার দিন থাকাতে বিলম্বে বাড়ি ফিরিবার কথা। কিন্তু সন্ধ্যা হইতে না হইতেই আমাকে বাড়ির দিকে টানিতে লাগিল। কে টানিতে লাগিল বলিতে পারি না; কিন্তু মনে হইল, আর বিলম্বব করা উচিত হয় না। মনে হইল, সকলে বসিয়া আছে। রিপোর্ট অসমাপত রাখিয়া সোলার টপি মাথায় দিয়া সেই সন্ধ্যাধসর তরচ্ছোয়াঘন নিজন পথ রথচরুশদে সচকিত করিয়া সেই অন্ধকার শৈলান্তবতী নিস্তৰ প্ৰকাণ্ড প্রাসাদে গিয়া উত্তীর্ণ হইলাম । সিড়ির উপরে সম্মুখের ঘরটি অতিবৃহৎ । তিন সারি বড়ো বড়ো থামের উপর কারকোর্যখচিত খিলানে বিস্তীর্ণ ছাদ ধরিয়া রাখিয়াছে। এই প্রকাণ্ড ঘরটি আপনার বিপলেশন্যতাভরে অহনিশি গম গম করিতে থাকে। সেদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে তখনও প্রদীপ জালানো হয় নাই । দরজা ঠেলিয়া আমি সেই বাহং ঘরে যেমন প্রবেশ করিলাম অমনি মনে হইল, ঘরের মধ্যে যেন ভারি একটা বিপ্লব বাধিয়া গেল-- যেন হঠাৎ সভা ভঙ্গ করিয়া চারি দিকের দরজা জানলা ঘর পথ বারান্দা দিয়া কে কোন দিকে পলাইল তাহার ঠিকানা নাই। আমি কোথাও কিছু না দেখিতে পাইয়া অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। শরীর একপ্রকার আবেশে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। যেন বহুদিবসের লতোবশিষ্ট মাথাঘষা ও আতরের মদ গন্ধ আমার নাসার মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল। আমি সেই দীপহীন জনহীন প্রকাণ্ড ঘরের প্রাচীন প্রস্তরস্তম্ভশ্রেণীর মাঝখানে পড়িাইয়া শুনিতে পাইলাম-- ঝঝার শব্দে ফোয়ারার জল সাদা পাথরের উপরে আসিয়া পড়িতেছে, সেতারে কী সদর বাজিতেছে বুঝিতে পারিতেছি না, কোথাও বা বশীভূষণের শিঞ্জিত, কোথাও বা নপরের নিক্কণ, কখনও বা বহৎ তমঘণ্টায় প্রহর বাজিবার শব্দ, অতি দরে নহবতের আলাপ, বাতাসে দোদুল্যমান ঝাড়ের সফটিকদোলকগুলির ঠন ঠন ধনি, বারান্দা হইতে খাঁচার বলেবলের গান, বাগান হইতে পোষা সারসের ডাক আমার চতুদিকে একটা প্রেতলোকের রাগিণী সস্টি করিতে লাগিল। আমার এমন একটা মোহ উপস্থিত হইল, মনে হইল এই অপশ্য অগম্য অবাস্তব ব্যাপারই জগতে একমাত্র সত্য, আর-সমস্তই মিথ্যা মরীচিকা। আমি যে আমি— অর্থাৎ আমি যে শ্রীযন্ত অমক, ‘অমুকের জ্যেষ্ঠ পত্র, তুলার মাশলে সংগ্ৰহ করিয়া সাড়ে চার শো টাকা বেতন পাই, আমি যে সোলার টপি এবং খাটো কোতা পরিয়া টমটম, হাঁকাইয়া আপিস করিতে যাই, এ-সমস্তই আমার কাছে এমন অদ্ভুত হাস্যকর অমলক মিথ্যা কথা বলিয়া বোধ হইল যে, আমি সেই বিশাল নিস্তব্ধ অন্ধকার ঘরের মাঝখানে দাঁড়াইয়া হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিলাম। 噸 তখনই আমার মসলমান ভূত্য প্রজবলিত কেরোসিন ল্যাম্প হাতে করিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। সে আমাকে পাগল মনে করিল কি না জানি না, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আমার স্মরণ হইল যে, আমি অমকেচন্দ্রের জ্যেষ্ঠপত্র শ্ৰীযন্ত অমকেনাথ বটে; ইহাও মনে করিলাম যে, জগতের ভিতরে অথবা বাহিরে কোথাও অমতে ফোয়ারা নিত্যকাল উৎসারিত ও অদশ্য অঙ্গুলির আঘাতে কোনো মায়া-সেতারে অনন্ত রাগিণী ধৰনিত হইতেছে কি না তাহা আমাদের মহাকবি ও কবিবরেরাই বলিতে পারেন, কিন্তু এ