পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७०२ গল্পগুচ্ছ প্রবত্ত হইল ; মাঝির যখন তামাক খাইবার আবশ্যক, তখন সে নিজে গিয়া হাল ধরিল— যখন যে দিকে পাল ফিরানো আবশ্যক সমস্ত সে দক্ষতার সহিত সম্পন্ন कब्लिन्ना मिळन । সন্ধ্যার প্রাককালে অন্নপ্রণা তারাপদকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, "রাত্রে তুমি কণী খাও।” তারাপদ কহিল, "যা পাই তাই খাই : সকল দিন খাইও না।” এই সন্দর ব্রাহরণবালকটির আতিথ্যগ্রহণে ঔদাসীন্য অন্নপণাকে ঈষৎ পীড়া দিতে লাগিল। তাঁহার বড়ো ইচ্ছা, খাওয়াইয়া পরাইয়া এই গহচু্যত পান্থ বালকটিকে পরিতৃপ্ত করিয়া দেন। কিন্তু কিসে যে তাহার পরিতোষ হইবে তাহার কোনো সন্ধান পাইলেন না। অন্নপণ চাকরদের ডাকিয়া গ্রাম হইতে দুধ মিন্টান্ন প্রভৃতি ক্ৰয় করিয়া আনিবার জন্য ধমধাম বাধাইয়া দিলেন। তারাপদ যথাপরিমাণে আহার করিল, কিন্তু দন্ধ খাইল না। মৌনস্বভাব মতিলালবাবুও তাহাকে দুধ খাইবার জন্য অনুরোধ করিলেন ; সে সংক্ষেপে বলিল, “আমার ভালো লাগে না ।” নদীর উপর দুই-তিনদিন গেল। তারাপদ রাধাবাড়া, বাজার-করা হইতে নৌকা চালনা পর্যন্ত সকল কাজেই স্বেচ্ছা ও তৎপরতার সহিত যোগ দিল । যে-কোনো দশ্য তাহার চোখের সম্মুখে আসে তাহার প্রতি তারাপদর সকৌতুহল দষ্টি ধাবিত হয়, যে-কোনো কাজ তাহার হাতের কাছে আসিয়া উপস্থিত হয় তাহাতেই সে আপনি আকৃষ্ট হইয়া পড়ে। তাহার দস্টি, তাহার হস্ত, তাহার মন সবদাই সচল হইয়া আছে ; এইজন্য সে এই নিত্যসচলা প্রকৃতির মতো সবাদাই নিশিচন্ত উদাসীন, অথচ সবাদাই ক্লিয়াসক্ত। মানুষমাত্রেরই নিজের একটি স্বতন্ত্র অধিষ্ঠানভূমি আছে, কিন্তু তারাপদ এই অনন্ত নীলাম্বরবাহী বিশ্বপ্রবাহেব একটি আনন্দোজল তরঙ্গ-- ভূতভবিষ্যতের সহিত তাহার কোনো সম্বন্ধ নাই-- সম্মুখাভিমুখে চলিয়া যাওয়াই তাহার একমাত্র কায । এ দিকে অনেকদিন নানা সম্প্রদায়ের সহিত যোগ দিয়া অনেক প্রকার মনোরঞ্জনী বিদ্যা তাহার আয়ত্ত হইয়াছিল। কোনোপ্রকার চিন্তার দ্বারা আচ্ছন্ন না থাকাতে তাহার নিমাল সমতিপটে সকল জিনিস আশ্চৰ্য সহজে মুদ্রিত হইয়া যাইত। পাঁচালি, কথকতা, কৗতনগান, যাত্রাভিনয়ের সন্দীঘ খণ্ডসকল তাহার কাঠাগ্রে ছিল। মতিলালবাব চিরপ্রথমত একদিন সন্ধ্যাবেলায় তাঁহার সন্ত্রী-কন্যাকে রামায়ণ পড়িয়া শনাইতেছিলেন: কুশলবের কথার সচনা হইতেছে, এমন সময়ে তারাপদ উৎসাহ সম্বরণ করিতে না পারিয়া নৌকার ছাদের উপর হইতে নামিয়া আসিয়া কহিল, "বই রাখন। আমি কুশলবের গান করি, আপনারা শুনে যান ।” এই বলিয়া সে কুশলবের পাঁচালি আরম্ভ করিয়া দিল। বাঁশির মতো সমিষ্ট পরিপণাস্তবরে দাশরায়ের অন্যপ্রাস ক্ষিপ্রবেগে বর্ষণ করিয়া চলিল; দাঁড়ি-মাঝি সকলেই । বোরের কাছে আসিয়া ঝ:কিয়া পড়িল; হাস্য করণো এবং সংগীতে সেই নদীতীরের সন্ধ্যাকাশে এক অপব রসস্রোত প্রবাহিত হইতে লাগিল—দই নিস্তৰ তটভূমি ক্ষণকালের জন্য উৎকণ্ঠিত হইয়া সেই দিকে কান দিয়া রহিল; যখন শেষ হইয়া গেল সকলেই ব্যথিত চিত্তে দীঘনিশ্বাস ফেলিয়া ভাবিল, ইহারই মধ্যে শেষ হইল কেন।