পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○80 গল্পগুচ্ছ অব্যাহত -ভাবে কালস্রোতের তরঙ্গচড়ায় ভাসমান হইয়া সম্মুখে প্রবাহিত হইয়া যাইত, সে আজকাল এক-একবার অন্যমনস্ক হইয়া বিচিত্র দিবাসব নজালের মধ্যে জড়ীভূত হইয়া পড়ে। এক-একদিন পড়াশনা ছাড়িয়া দিয়া সে মতিবাবরে লাইব্রেরির মধ্যে প্রবেশ করিয়া ছবির বইয়ের পাতা উলটাইতে থাকিত; সেই ছবিগুলির মিশ্রণে যে কল্পনালোক সজিত হইত তাহা পাবেীকার হইতে অনেক স্বতন্ত্র এবং অধিকতর রঙিন। চারীর অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করিয়া সে আর পড়বের মতো স্বভাবত পরিহাস করিতে পারিত না, দুষ্টামি করিলে তাহাকে মারিবার কথা মনেও উদয় হইত না । নিজের এই গঢ় পরিবতন, এই আবন্ধ আসক্ত ভাব তাহার নিজের কাছে এক নতন সবপ্নের মতো মনে হইতে লাগিল । শ্রাবণ মাসে বিবাহের শুভদিন সিথর করিয়া মতিবাব তারাপদর মা ও ভাইদের আনিতে পাঠাইলেন, তারাপদকে তাহা জানিতে দিলেন না। কলিকাতার মোক্তারকে গড়ের বাদ্য বায়না দিতে আদেশ করিলেন এবং জিনিসপত্রের ফদ পাঠাইয়া দিলেন । আকাশে নববর্ষার মেঘ উঠিল। গ্রামের নদী এতদিন শাকপ্রায় হইয়া ছিল, মাঝে মাঝে কেবল এক-একটা ডোবায় জল বাধিয়া থাকিত ; ছোটো ছোটো নৌকা সেই পঙ্কিল জলে ডোবানো ছিল এবং শঙ্কে নদীপথে গোরুর গাড়ি -চলাচলের সুগভীর চক্ৰচিহ্ন ক্ষোদিত হইতেছিল— এমন সময় একদিন পিতৃগহ-প্রত্যাগত পাবতীর মতো, কোথা হইতে দ্রুতগামিনী জলধারা কলহাস্য-সহকারে গ্রামের শন্যবক্ষে আসিয়া সমাগত হইল— উলঙ্গ বালকবালিকারা তীরে আসিয়া উচ্চৈঃস্বরে নত্য করিতে লাগিল, অতৃপ্ত আনন্দে বারবার জলে ঝাঁপ দিয়া দিয়া নদীকে যেন আলিঙ্গন করিয়া ধবিতে লাগিল, কুটিরবাসিনীরা তাহাদের পরিচিত প্রিয়সঙ্গিনীকে দেখিবার জন্য বহির হইয়া আসিল—শকে নিজীব গ্রামের মধ্যে কোথা হইতে এক প্রবল বিপুল প্ৰাণহিল্লোল আসিয়া প্রবেশ করিল। দেশবিদেশ হইতে বোঝাই হইয়া ছোটো বড়ো আয়তনের নৌকা আসিতে লাগিল— বাজারের ঘাট সন্ধ্যাবেলায় বিদেশী মাঝির সংগীতে ধৰনিত হইয়া উঠিল। দুই তীরের গ্রামগুলি সম্ভবৎসর আপনার নিভৃত কোণে আপনার ক্ষুদ্র ঘরকন্না লইয়া একাকিনী দিনযাপন করিতে থাকে, বর্ষার সময় বাহিরের বৃহৎ পথিবী বিচিত্র পণ্যোপহার লইয়া গৈরিকবর্ণ জলরথে চড়িয়া এই গ্রামকনাকাগুলির তত্ত্ব লইতে আসে ; তখন জগতের সঙ্গে আত্মীয়তাগবে কিছুদিনের জন্য তাহাদের ক্ষুদ্রতা ঘুচিয়া যায়, সমস্তই সচল সজাগ সজীব হইয়া উঠে এবং মৌন নিস্তব্ধ দেশের মধ্যে সদর রাজ্যের কলালাপধৰনি আসিয়া চারি দিকের আকাশকে আন্দোলিত করিয়া তুলে। এই সময়ে কুড়লকাটায় নাগবাবদের এলাকায় বিখ্যাত রথযাত্রার মেলা হইবে। জ্যোৎসনা-সন্ধ্যায় তারাপদ ঘাটে গিয়া দেখিল, কোনো নৌকা নাগরদোলা, কোনো নৌকা যাত্রার দল, কোনো নৌকা পণ্যদ্রব্য লইয়া প্রবল নবীন স্রোতের মখে দ্রুতবেগে মেলাঅভিমুখে চলিয়াছে; কলিকাতার কনসটের দল বিপলেশব্দে দ্রুততালের বাজনা জড়িয়া দিয়াছে, যাত্রার দল বেহালার সঙ্গে গান গাহিতেছে এবং সমের কাছে হাহাহাঃ শব্দে চীৎকার উঠিতেছে, পশ্চিমদেশী নৌকার দড়িমাল্লাগুলো কেবলমাত্র মাদল এবং করতাল লইয়া উন্মত্ত উৎসাহে বিনা সংগীতে খচমচ শব্দে আকাশ বিদীগ করিতেছে— উদ্দীপনার সীমা নাই। দেখিতে দেখিতে পাবদিগন্ত হইতে ঘন মেঘরাশি প্রকাণ্ড কালো পাল তুলিয়া দিয়া আকাশের মাঝখানে উঠিয়া পড়িল, চাঁদ আচ্ছন্ন হইল—