পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○○3 গল্পগুচ্ছ বচিভঙ্গবিহীন প্রশান্ত যমনাবক্ষোবাহিত একখানি অদশ্য জীণ নৌকা সেই জ্যোৎস্নারজনীর সৌম্যসন্দর শান্তশীতল অনন্ত ভুবনমোহন মৃত্যুর প্রসারিত আলিঙ্গনপাশ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া আমাকে জীবনের পথে টানিয়া লইয়া চলিল। আমি মোহস্বপ্নাভিহতার ন্যায় যমনার তীরে তীরে কোথাও-বা কাশবন, কোথাও-বা মরবালকো কোথাও-বা বন্ধর বিদীণ তট, কোথাও-বা ঘনগমদগম বনখণ্ডের ভিতর দিয়া চলিতে লাগিলাম।” এইখানে বক্তা চুপ করিল। আমিও কোনো কথা কহিলাম না। অনেকক্ষণ পরে নবাবদহিতা কহিল, "ইহার পরে ঘটনাবলী বড়ো জটিল। সে কেমন করিয়া বিশ্লেষ করিয়া পরিস্কার কবিয়া বলিব জানি না । একটা গহন অরণ্যের মাঝখান দিয়া যাত্রা করিয়াছিলাম, ঠিক কোন পথ দিয়া কখন চলিয়ছিলাম সে কি আর খাজিয়া বাহির করিতে পারি। কোথায় আরম্ভ করিব, কোথায় শেষ করিব, কোনটা ত্যাগ করিব, কোনটা রাখিব, সমস্ত কাহিনীকে কী উপায়ে এমন পপষ্ট প্রত্যক্ষ করিয়া তুলিব যাহাতে কিছই অসাধ্য অসম্ভব অপ্রকৃত বোধ না হয়। কিন্তু জীবনের এই কয়টা দিনে বঝিয়াছি যে, অসাধ্য অসম্ভব কিছুই নাই। নবাব-অন্তঃপরের বালিকার পক্ষে বাহিরের সংসার একান্ত দগম বলিয়া মনে হইতে পারে, কিন্তু তাহা কাল্পনিক : একবার বাহিব হইয়া পড়িলেই একটা চলিবার পথ থাকেই। সে পথ নবাবি পথ নহে, কিন্তু পথ ; সে পথে মানুষ চিরকাল চলিয়া আসিয়াছে— তাহা বন্ধর বিচিত্র সীমাহীন, তাহা শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত, তাহা সখেদঃখে বাধাবিঘো জটিল, কিন্তু তাহা পথ। এই সাধারণ মানবের পথে একাকিনী নবাবদ হিতার সন্দীঘ ভ্রমণবৃত্তান্ত সুখশ্রাব্য হইবে না, হইলেও সে-সব কথা বলিবার উৎসাহ আমার নাই। এক কথায়, দুঃখকষ্ট বিপদ অবমাননা অনেক ভোগ করিতে হইয়াছে, তব জীবন অসহ্য হয় নাই। আতসবাজির মতো যত দাহন ততই উন্দাম গতি লাভ করিয়াছি। যতক্ষণ বেগে চলিয়াছিলাম ততক্ষণ পড়িতেছি বলিয়া বোধ ছিল না, আজ হঠাৎ সেই পরম দুঃখের, সেই চরম সখের আলোকশিখাটি নিবিয়া গিয়া এই পথপ্রান্তের ধুলির উপর জড়পদার্থের ন্যায পড়িয়া গিয়াছি— আজ আমার যাত্রা শেষ হইয়া গেছে, এইখানেই আমার কাহিনী সমাপত।” এই বলিয়া নবাবপত্রী থামিল। আমি মনে মনে ঘাড় নাড়িলাম ; এখানে তো কোনোমতেই শেষ হয় না। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া ভাঙা হিন্দিতে বলিলাম, “বেয়াদবি মাপ করিবেন, শেষ দিককার কথাটা আর-একটা খোলসা করিয়া বলিলে অধীনের মনের ব্যাকুলতা অনেকটা হ্রাস হয়।” নবাবপত্রী হাসিলেন। বুঝিলাম, আমার ভাঙা হিন্দিতে ফল হইয়াছে। যদি আমি খাস হিন্দিতে বাং চালাইতে পারিতাম তাহা হইলে আমার কাছে তাঁহার লজা ভাঙিত না, কিন্তু আমি যে তাঁহার মাতৃভাষা অতি অল্পই জানি সেইটেই আমাদের উভয়ের মধ্যে বহৎ ব্যবধান, সেইটেই একটা আত্র। তিনি পনরায় আরম্ভ করিলেন, “কেশরলালের সংবাদ আমি প্রায়ই পাইতাম কিন্তু