পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অধ্যাপক Oq& সহকারে বাচালতা প্রকাশ করিতেছিলাম; আলোচনা কিয়দাদরে অগ্রসর হইবামার কিরণ উঠিয়া গেল, এবং অনতিকাল পরেই সন্মাখের বারান্দায় একটা তোলা উনান এবং রধিবার সরঞ্জাম আনিয়া রাখিয়া ভবনাথবাবকে ভৎসনা করিয়া বলিল, “বাবা, কেন তুমি মহীলবাবকে ঐ-সকল শক্ত কথা লইয়া ব্যথা বকাইতেছ! আসন মহীন্দ্রবাব, তার চেয়ে আমার রান্নায় যোগ দিলে কাজে লাগিবে।” ভবনাথবাবর কোনো দোষ ছিল না, এবং কিরণ তাহা অবগত ছিল। কিন্তু ভবনাথবাব অপরাধীর মতো অনুতপ্ত হইয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “তা বটে ! আচ্ছা ও কথাটা আর-একদিন হইবে।” এই বলিয়া নিরন্দবিন্নচিত্তে তিনি তাঁহার নিত্যনিয়মিত অধ্যয়নে নিযন্তে হইলেন। আবার আর-একদিন অপরাহ্লে আর-একটা গরতের কথা পাড়িয়া ভবনাথবাবকে স্তম্ভিত করিয়া দিতেছি এমনসময় মাঝখানে আসিয়া কিরণ কহিল, “মহীন্দ্রবাব, অবলাকে সাহায্য করিতে হইবে । দেয়ালে লতা চড়াইব, নাগাল পাইতেছি না, আপনাকে এই পেরেকগুলি মারিয়া দিতে হইবে।” আমি উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়া গেলাম, ভবনাথবাবুও প্রফুল্লমনে পড়িতে বসিলেন । এমনি প্রায় যখনই ভবনাথবাবরে কাছে আমি ভারি কথা পাড়িবার উপক্ৰম করি, কিরণ একটা-না-একটা কাজের ছাতা ধরিয়া ভঙ্গ করিয়া দেয় । ইহাতে আমি মনেমনে পলকিত হইয়া উঠিতাম ; আমি বুঝিতাম যে, কিরণের কাছে আমি ধরা পড়িয়াছি ; সে কেমন করিয়া বুঝিতে পারিয়াছে যে, ভবনাথবাবরে সহিত তত্ত্বালোচনা আমার জীবনের চরম সুখ নহে। বাহাবস্তুর সহিত আমাদের ইন্দ্ৰিয়বোধের সম্প্ৰবন্ধ নির্ণয় করিতে গিয়া যখন দরহে রহস্যরসাতলের মধ্যপথে অবতীর্ণ হইয়াছি এমনসময় কিরণ আসিয়া বলিত, মহীন্দ্রবাব, রান্নাঘরের পাশে আমার বেগনের খেত আপনাকে দেখাইয়া আনি গে, চলন ।” আকাশকে অসীম মনে করা কেবল আমাদের অনমানমাত্র, আমাদের অভিজ্ঞতা ও কম্পনাশক্তির বাহিরে কোথাও কোনো-এক রাপে তাহার সীমা থাকা কিছুই অসম্ভব নহে, ইত্যাকার মন্তব্য প্রকাশ করিতেছি, এমনসময় কিরণ আসিয়া বলিত, “মহীন্দ্রবাব দটা আম পাকিয়াছে, আপনাকে ডাল নামাইয়া ধরিতে হইবে।” কী উদ্ধার, কী মন্তি ! অকল সমুদ্রের মাঝখান হইতে এক মহতে কী সন্দের কলে আসিয়া উঠিতম। অনন্ত আকাশ ও বাহাবস্তু সম্বন্ধে সংশয়জাল যতই দশোচ্ছদ্য জটিল হউক না কেন, কিরণের বেগনের খেত বা আমতলা সম্বন্ধে কোনোপ্রকার দাবহতা ও সন্দেহের লেশমাত্র ছিল না। কাব্যে বা উপন্যাসে তাহা উল্লেখযোগ্য নহে কিন্তু জীবনে তাহা সমদ্রবেষ্টিত বীপের ন্যায় মনোহর। মাটিতে পা ঠেকা যে কী আরাম তাহা সে-ই জানে যে বহনক্ষণ জলের মধ্যে সাঁতার দিয়াছে। আমি এতদিন কল্পনায় যে প্রেমসমুদ্র সজেন করিয়াছিলাম তাহা যদি সত্য হইত তবে সেখানে চিরকাল যে কী করিয়া ভাসিয়া বেড়াইতাম তাহা বলিতে পারি না। সেখানে আকাশও অসীম, সমন্ত্ৰও অসীম, সেখান হইতে আমাদের প্রতিদিবসের বিচিত্র জীবনযাত্রার সীমাবদ্ধ ব্যাপার একেবারে নিবাসিত, সেখানে তুচ্ছতার লেশমাত্র নাই, সেখানে কেবল ছন্দে লয়ে সংগীতে ভাব বান্ত করিতে হয়, এবং তলাইতে গেলে কোথাও তল পাওয়া