পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দটিদান 8వళి দেহতত্ত্বগান গঞ্জনস্বরে শনিতে পাইলাম না; সেই নবান্নের উৎসব শীতের শিশিরস্নাত আকাশের মধ্যে সজীব হইয়া জাগিয়া উঠিল, কিন্তু ঢেকিশালে নতন ধান কুটিবার জনতার মধ্যে আমার ছোটো ছোটো পল্লিসঙ্গিনীদের সমাগম কোথায় গেল ! সন্ধ্যাবেলা আদরে কোথা হইতে হামবাধনি শুনিতে পাই, তখন মনে পড়ে, মা সন্ধ্যাদীপ হাতে করিয়া গোয়ালে আলো দেখাইতে যাইতেছেন; সেইসঙ্গে ভিজা জাবনার ও খড়জবালানো ধোঁয়ার গন্ধ যেন হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করে এবং শনিতে পাই, পুকুরের পাড়ে বিদ্যালংকারদের ঠাকুরবাড়ি হইতে কাসরঘণ্টার শব্দ আসিতেছে। কে যেন আমার সেই শিশুকালের আটটি বৎসরের মধ্য হইতে তাহার সমস্ত বস্তু-অংশ ছকিয়া লইয়া কেবল তাহার রসটকুে গন্ধটকুে আমার চারি দিকে রাশীকৃত করিয়াছে। এইসঙ্গে আমার সেই ছেলেবেলাকার ব্রত এবং ভোরবেলায় ফল তুলিয়া শিবপজার কথা মনে পড়িল। এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে, কলিকাতার আলাপ আলোচনা আনাগোনার গোলমালে বন্ধির একটা বিকার ঘটেই। ধমকমী-ভক্তিশ্রদ্ধার মধ্যে নিমাল সরলতাটুকু থাকে না । সেদিনের কথা আমার মনে পড়ে যেদিন অন্ধ হওয়ার পরে কলিকাতায় আমার পল্লিবাসিনী এক সখী আসিয়া আমাকে বলিয়াছিল, "তোর রাগ হয় না, কুম ? আমি হইলে এমন স্বামীর মুখ দেখিতাম না।” আমি বলিলাম, “ভাই, মুখ দেখা তো বন্ধই বটে, সেজন্যে এ পোড়া চোখের উপর রাগ হয়, কিন্তু স্বামীর উপর রাগ করিতে যাইব কেন।” যথাসময়ে ডাক্তার ডাকেন নাই বলিয়া লাবণ্য আমার স্বামীর উপর অত্যন্ত রাগিয়াছিল এবং আমাকেও রাগাইবার চেষ্টা করিয়াছিল। আমি তাহাকে বঝোইলাম, সংসারে থাকিলে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় জ্ঞানে অজ্ঞানে ভুলে ভ্রান্তিতে দুঃখ সুখ নানারকম ঘটিয়া থাকে ; কিন্তু মনের মধ্যে যদি ভক্তি সিথর রাখিতে পারি তবে দুঃখের মধ্যেও একটা শান্তি থাকে, নহিলে কেবল রাগারগি রেষারেষি বকবিকি করিয়াই জীবন কাটিয়া যায় । অন্ধ হইয়াছি এই তো যথেষ্ট দুঃখ তাহার পরে স্বামীর প্রতি বিদ্বেষ করিয়া দুঃখের বোঝা বাড়াইব কেন। আমার মতো বালিকার মুখে সেকেলে কথা শুনিয়া লাবণ্য রাগ করিয়া অবজ্ঞাভরে নাথ নাড়িয়া চলিয় গেল। কিন্তু যাই বলি, কথার মধ্যে বিষ আছে, কথা একেবারে ব্যথ হয় না। লাবণ্যের মখ হইতে রাগের কথা আমার মনের মধ্যে দটো-একটা প্ৰফুলিঙ্গ ফেলিযা গিয়াছিল, আমি সেটা পা দিয়া মাড়াইয়া নিবাইয়া দিয়াছিলাম, কিন্তু তব দটো-একটা দাগ থাকিয়াছিল। তাই বলিতেছিলাম, কলিকাতায় অনেক তক, অনেক কথা : সেখানে দেখিতে দেখিতে বধি অকালে পাকিয়া কঠিন হইয়া উঠে। পাড়াগাঁয়ে আসিয়া আমার সেই শিবপজার শীতল শিউলিফলের গন্ধে হাদয়ের সমস্ত আশা ও বিশ্বাস আমার সেই শিশকোলের মতোই নবীন ও উজ্জল হইয়া উঠিল। দেবতায় আমার হদয় এবং আমার সংসার পরিপন্ণ হইয়া গেল। আমি মঠশিরে ল-টাইয়া পড়িলাম। বলিলাম, “হে দেব. আমার চক্ষ গেছে বেশ হইয়াছে, তুমি তো আমার আছ।” হায়, ভুল বলিয়াছিলাম। তুমি আমার আছ, এ কথাও পধার কথা। আমি তোমার আছি, কেবল এইটুকু বলিবারই অধিকার আছে। ওগো, একদিন কণ্ঠ চাপিয়া আমার দিলতা এই কথাটা আমাকে বলাইয়া লইবে । কিছুই না থাকিতে পারে, কিন্তু আমাকে থাকিতেই হইবে। কাহারও উপরে কোনো জোর নাই; কেবল নিজের উপরেই আছে। २१