পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ミO গল্পগুচ্ছ দই হাত বাড়াইয়া দেখিলাম, কোথায় আমার কী আছে! আমার স্বামী আসিয়া বিশেষ প্রফুল্লতা দেখাইয়া কহিলেন, "ইহারা গেলেন, এখন বাঁচা গেল, একট কাজকর্ম করিবার অবসর পাওয়া যাইবে।” ধিক ধিক আমাকে। আমার জন্য কেন এত চাতুরী। আমি কি সত্যকে ডরাই। আমি কি আঘাতকে কখনও ভয় করিয়াছি। আমার স্বামী কি জানেন না? যখন আমি দুই চক্ষ দিয়াছিলাম তখন আমি কি শান্তমনে আমার চিরান্ধকার গ্রহণ করি নাই। এতদিন আমার এবং আমার স্বামীর মধ্যে কেবল অন্ধতার অন্তরাল ছিল, আজ হইতে আর-একটা ব্যবধান সজন হইল। আমার স্বামী ভুলিয়াও কখনও হেমাঙ্গিনীর নাম আমার কাছে উচ্চারণ করিতেন না, যেন তাঁহার সম্পকীয় সংসার হইতে হেমাঙ্গিনী একেবারে লন্ত হইয়া গেছে, যেন সেখানে সে কোনোকালে লেশমাত্র রেখাপাত করে নাই। অথচ পত্রদ্বারা তিনি ষে সবদাই তাহার খবর পাইতেছেন, তাহা আমি অনায়াসে অনুভব করিতে পারিতাম; যেমন পলকুরের মধ্যে বন্যার জল যেদিন একট প্রবেশ করে সেইদিনই পদ্মের ডাঁটায় টান পড়ে, তেমনি তাঁহার ভিতরে একটও যেদিন সফীতির সন্টার হয় সেদিন আমার হৃদয়ের মলের মধ্য হইতে আমি আপনি অনুভব করিতে পারি। কবে তিনি খবর পাইতেন এবং কবে পাইতেন না তাহা আমার কাছে কিছু অগোচর ছিল না। কিন্তু, আমিও তাঁহাকে তাহার কথা শুধাইতে পারিতাম না। আমার অন্ধকার হৃদয়ে সেই-যে উন্মত্ত উন্দাম উজ্জল সন্দের তারাটি ক্ষণকালের জন্য উদয় হইয়াছিল তাহার একট খবর পাইবার এবং তাহার কথা আলোচনা করিবার জন্য আমার প্রাণ তৃষিত হইয়া থাকিত, কিন্তু আমার স্বামীর কাছে মহেত্যের জন্য তাহার নাম করিবার অধিকার ছিল না। আমাদের দুজনার মাঝখানে বাক্যে এবং বেদনায় পরিপণ এই একটা নীরবতা অটলভাবে বিরাজ করিত। বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি একদিন ঝি আসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “মাঠাকরন, ঘাটে যে অনেক আয়োজনে নৌকা প্রস্তুত হইতেছে, বাবামশায় কোথায় বাইতেছেন।" আমি জানিতাম, একটা কী উদ্যোগ হইতেছে ; আমার আদষ্টাকাশে প্রথম কিছুদিন ঝড়ের পবীকার নিস্তব্ধতা এবং তাহার পরে প্রলয়ের ছিন্নবিচ্ছিন্ন মেঘ আসিয়া জমিতেছিল: সংহারকারী শংকর নীরব অঙ্গলির ইঙ্গিতে তাঁহার সমস্ত প্ৰলয়শক্তিকে আমার মাথার উপরে জড়ো করিতেছেন, তাহা আমি বুঝিতে পারিতেছিলাম। ঝিকে বলিলাম, “কই, আমি তো এখনও কেনো খবর পাই নাই।” ঝি আর-কোনো প্রশন জিজ্ঞাসা করিতে সাহস না করিয়া নিশবাস ফেলিয়া চলিয়া গেল । অনেক রাত্রে আমার স্বামী আসিয়া কহিলেন, “দরে এক জায়গায় আমার ডাক পড়িয়াছে, কাল ভোরেই আমাকে রওনা হইতে হইবে। বোধ করি ফিরিতে দিনদুইতিন বিলম্বব হইতে পারে।” আমি শয্যা হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলাম, “কেন আমাকে মিথ্যা বলিতেছ।” আমার স্বামী কল্পিত অসফট কণ্ঠে কহিলেন, "মিথ্যা কণী বলিলাম।” আমি কহিলাম, “তুমি বিবাহ করিতে যাইতেছ।” তিনি চুপ করিয়া রহিলেন। আমিও পিব হইয়া দাঁড়াইয়া, রহিলাম। অনেকক্ষণ ঘরে কোনো শব্দ রহিল না। শেষে আমি বলিলাম, “একটা উত্তর দাও। বলো, হাঁ আমি বিবাহ করিতে যাইতেছি।”