পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8○O গল্পগুচ্ছ দবধি ভিটা ছাড়িতে হইল। কেমন করিয়া তাহা খোলসা করিয়া বলিব না, আভাস দিব মাত্র। আমি পাড়াগে’য়ে নেটিভ ডাক্তার, পলিসের থানার সম্মুখে আমার বাড়ি । ঘমরাজের সহিত আমার যে পরিমাণ আনুগত্য ছিল দারোগাবাবদের সহিত তাহা অপেক্ষা কম ছিল না, সতরাং নর এবং নারায়ণের বারা মানুষের যত বিবিধরকমের পীড়া ঘটিতে পারে তাহা আমার সগোচর ছিল। যেমন মণির বারা বলয়ের এবং বলয়ের স্বারা মণির শোভা বধি হয় তেমনি আমার মধ্যস্থতায় দারোগার এবং দারোগার মধ্যস্থতায় আমার উত্তরোত্তর আর্থিক শ্ৰীবধি দুটিতেছিল। এই-সকল ঘনিষ্ঠ কারণে হাল নিয়মের কৃতবিদ্য দারোগা ললিত চক্লবতীর সঙ্গে আমার একটা বিশেষ বন্ধত্বে ছিল। তাঁহার একটি অরক্ষণীয়া আত্মীয়া কন্যার সহিত বিবাহের জন্য মাঝে মাঝে অনুরোধ করিয়া আমাকেও প্রায় তিনি অরক্ষণীয় করিয়া তুলিয়াছিলেন। কিন্তু, শশী আমার একমাত্র কন্যা, মাতৃহীনা, তাহাকে বিমাতার হাতে সমপণ করিতে পারিলাম না। বষে বর্ষে নতেন পঞ্জিকার মতে বিবাহের কত শুভলগ্নই ব্যথ হইল। আমারই চোখের সম্মুখে কত যোগ্য এবং অযোগ্য পাত্র চতুদোলায় চড়িল, আমি কেবল বরযাত্রীর দলে বাহির-বাড়িতে মিষ্টান্ন খাইয়া নিশ্বাস ফেলিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম । শশাঁর বয়স বারো হইয়া প্রায় তেরোয় পড়ে। কিছু সুবিধামত টাকার জোগাড় করিতে পারিলেই মেয়েটিকে একটি বিশিষ্ট বড়োঘরে বিবাহ দিতে পারিব, এমন আশা পাইয়াছি। সেই কমটি শেষ করিতে পারিলে অবিলম্বেব আর-একটি শুভকমের আয়োজনে মনোনিবেশ করিতে পারিব । সেই অত্যাবশ্যক টাকাটার কথা ধ্যান করিতেছিলাম, এমনসময় তুলসীপাড়ার হরিনাথ মজুমদার আসিয়া আমার পায়ে ধরিয়া কাদিয়া পড়িল। কথাটা এই, তাহার বিধবা কন্যা রাত্রে হঠাৎ মারা গিয়াছে, শত্রপেক্ষ গভ’পাতের অপবাদ দিয়া দারোগার কাছে বেনামি পত্র লিখিয়াছে। এক্ষণে পলিস তাহার মতদেহ লইয়া টানাটানি করিতে উদ্যত । সদ্য কন্যাশোকের উপর এতবড়ো অপমানের আঘাত তাহার পক্ষে অসহ্য হইয়াছে। আমি ডাক্তারও বটে, দারোগার বন্ধও বটে, কোনোমতে উদ্ধার করিতে হইবে । লক্ষী যখন ইচ্ছা করেন তখন এমনি করিয়াই কখনও সদর কখনও খিড়কি দরজা দিয়া অনাহত আসিয়া উপস্থিত হন । আমি ঘাড় নাড়িয়া বলিলাম, “ব্যাপারটা বড়ো গরতর।” দটো-একটা কম্পিত উদাহরণ প্রয়োগ করিলাম, কম্পমান বন্ধ হরিনাথ শিশর মতো কাঁদিতে লাগিল। বিস্তারিত বলা বাহুল্য, কন্যার অন্ত্যেষ্টি-সংকারের সংযোগ করিতে হরিনাথ কতুর হইয়া গেল। আমার কন্যা শশী করণ স্বরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, ঐ বড়ো তোমার পায়ে ধরিয়া কেন অমন করিয়া কাঁদতেছিল।" আমি তাহাকে ধমক দিয়া বলিলাম, “যা যা, তোর এত খবরে দরকার কাঁ।”