পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

3bf 。 গল্পগুচ্ছ শনিতে পাইয়া ত্রস্তপদে গিয়া দেখিল, চার মাটিতে পড়িয়া উপড় হইয়া কান্না রোধ কী ভুল বঝিয়াছিলাম। চারীর স্বভাব এতই চাপা যে, আমার কাছেও হাদয়ের কোনো বেদনা প্রকাশ করিতে চাহে না। যাহাদের প্রকৃতি এইরুপ তাহাদের ভালোবাসা সুগভীর এবং তাহাদের বেদনাও অত্যন্ত বেশি। চারার প্রেম সাধারণ সত্ৰীলোকদের ন্যায় বাহির হইতে তেমন পরিদশ্যমান নহে, ভূপতি তাহা মনে-মনে ঠাহর করিয়া দেখিল। ভূপতি চারার ভালোবাসার উচ্ছাস কখনও দেখে নাই; আজ বিশেষ করিয়া ব্যঝিল, তাহার কারণ অন্তরের দিকেই চারীর ভালোবাসার গোপন প্রসার। ভূপতি নিজেও বাহিরে প্রকাশ করিতে অপট; চার্যর প্রকৃতিতেও হৃদয়াবেগের সংগভীর অন্তঃশীলতার পরিচয় পাইয়া সে একটা তৃপ্তি অনুভব করিল। ভূপতি তখন চারীর পাশে বসিয়া কোনো কথা না বলিয়া ধীরে ধীরে তাহার গায়ে হাত বলাইয়া দিতে লাগিল। কী করিয়া সাতুনা করিতে হয় ভূপতির তাহা জানা ছিল না— ইহা সে বঝিল না, শোককে যখন কেহ অন্ধকারে কন্ঠ চাপিয়া হত্যা করিতে চাহে তখন সাক্ষী বসিয়া থাকিলে ভালো লাগে না । চতুদশ পরিচ্ছেদ ভূপতি যখন তাহার খবরের কাগজ হইতে অবসর লইল তখন নিজের ভবিষ্যতের একটা ছবি নিজের মনের মধ্যে অকিয়া লইয়াছিল। প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, কোনোপ্রকার দরাশা-দুশ্চেষ্টায় যাইবে না, চারকে লইয়া পড়াশনা ভালোবাসা এবং প্রতিদিনের ছোটোখাটো গাহসিথ্য কতব্য পালন করিয়া চলিবে । মনে করিয়াছিল, যে-সকল ঘোরো সখ সবচেয়ে সলভ অথচ সন্দের, সবাদাই নাড়াচাড়ার যোগ্য অথচ পবিত্র নিমাল, সেই সহজলভ্য সখগুলির বারা তাহার জীবনের গহকোণটিতে সন্ধ্যাপ্রদীপ জালাইয়া নিভৃত শান্তির অবতারণা করিবে। হাসি গল্প পরিহাস, পরপরের মনোরঞ্জনের জন্য প্রত্যহ ছোটোখাটো আয়োজন, ইহাতে অধিক চেষ্টা আবশ্যক হয় না অথচ সথে অপৰ্যাপ্ত হইয়া উঠে। কাৰ্যকালে দেখিল, সহজ সুখ সহজ নহে। যাহা মল্যে দিয়া কিনিতে হয় না তাহা যদি আপনি হাতের কাছে না পাওয়া যায় তবে আর কোনোমতেই কোথাও খাজিয়া পাইবার উপায় থাকে না। ভূপতি কোনোমতেই চারীর সঙ্গে বেশ করিয়া জমাইয়া লইতে পারিল না। ইহাতে সে নিজেকেই দোষ দিল। ভাবিল, “বারো বৎসর কেবল খবরের কাগজ লিখিয়া, সীর সঙ্গে কী করিয়া গল্প করিতে হয় সে বিদ্যা একেবারে খোয়াইয়াছি।” সন্ধ্যাদীপ জালিতেই ভূপতি আগ্রহের সহিত ঘরে যায়—সে দই-একটা কথা বলে, চার দইএকটা কথা বলে, তার পরে কী বলিবে ভূপতি কোনোমতেই ভাবিয়া পায় না। নিজের এই অক্ষমতায় সন্ত্রীর কাছে সে লন্জা বোধ করিতে থাকে। সন্ত্রীকে লইয়া গল্প করা সে এতই সহজ মনে করিয়াছিল অথচ মঢ়ের নিকট ইহা এতই শক্ত। সভাস্থলে বস্তৃতা করা ইহার চেয়ে সহজ ।