পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 গল্পগুচ্ছ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ রাইচরণ দেশে ফিরিয়া গেল। এতকাল তাহার সন্তানাদি হয় নাই, হইবার বিশেষ আশাও ছিল না। কিন্তু দৈবক্ৰমে বৎসর না যাইতেই তাহার সন্ত্রী অধিকবয়সে একটি পত্রসন্তান প্রসব করিয়া লোকলীলা সবরণ করিল। এই নবজাত শিশুটির প্রতি রাইচরণের অত্যন্ত বিদ্বেষ জন্মিল। মনে করিল, এ যেন ছল করিয়া খোকাবাবরে স্থান অধিকার করিতে আসিয়াছে। মনে করিল, প্রভুর একমাত্র ছেলেটি জলে ভাসাইয়া নিজে পত্রসখে উপভোগ করা যেন একটি মহাপাতক। রাইচরণের বিধবা ভগ্নী যদি না থাকিত তবে এ শিশুটি পথিবীর বায় বেশিদিন ভোগ করিতে পাইত না। আশ্চয্যের বিষয় এই যে, এই ছেলেটিও কিছুদিন বাদে চৌকাঠ পার হইতে আরম্ভ করিল, এবং সব প্রকার নিষেধ লঙ্ঘন করিতে সকৌতুক চতুরতা প্রকাশ করিতে লাগিল। এমনকি, ইহার কন্ঠস্বর হাস্যক্ৰন্দনধৰনি অনেকটা সেই শিশরেই মতো। একএকদিন যখন ইহার কান্না শনিত, রাইচরণের বকেটা সহসা ধড়াস করিয়া উঠিত; মনে হইত, দাদাবাব রাইচরণকে হারাইয়া কোথায় কাঁদিতেছে। ফেলনা— রাইচরণের ভগ্নী ইহার নাম রাখিয়াছিল ফেলনা— যথাসময়ে পিসিকে পিসি বলিয়া ডাকিল। সেই পরিচিত ডাক শুনিয়া একদিন হঠাৎ রাইচরণের মনে হইল—তবে তো খোকাবাব আমার মায়া ছাড়িতে পারে নাই। সে তো আমার ঘরে আসিয়াই জন্মগ্রহণ করিয়াছে।’ এই বিশ্বাসের অনুকলে কতকগুলি অকাট্য যুক্তি ছিল, প্রথমত, সে যাইবার অনতিবিলম্বেই ইহার জন্ম । দ্বিতীয়ত, এতকাল পরে সহসা যে তাহার সতীর গভে* সন্তান জন্মে এ কখনোই সত্রীর নিজগণে হইতে পারে না। তৃতীয়ত, এও হামাগড়ি দেয়, টলমল করিয়া চলে, এবং পিসিকে পিসি বলে। যে-সকল লক্ষণ থাকিলে ভবিষ্যতে জজ হইবার কথা তাহার অনেকগুলি ইহাতে বতিয়াছে। তখন মাঠাকরনের সেই দারুণ সন্দেহের কথা হঠাৎ মনে পড়িল-– আশ্চর্য হইয়া মনে মনে কহিল, ‘আহা, মায়ের মন জানিতে পারিয়াছিল তাহার ছেলেকে কে চুরি করিয়াছে।’ তখন, এতদিন শিশুকে যে অযত্ন কবিয়াছে সেজন্য বড়ো অনন্তাপ উপস্থিত হইল। শিশরে কাছে আবার ধরা দিল । এখন হইতে ফেলনাকে রাইচরণ এমন করিয়া মানুষ করিতে লাগিল যেন সে বড়ো ঘরের ছেলে। সাটিনের জামা কিনিয়া দিল। জরির টপি আনিল। মত সতীর গহনা গলাইয়া চুড়ি এবং বালা তৈয়ারি হইল। পাড়ার কোনো ছেলের সহিত তাহাকে খেলিতে দিত না— রাত্রিদিন নিজেই তাহার একমাত্র খেলার সঙ্গী হইল। পাড়ার ছেলেরা সুযোগ পাইলে তাহাকে নবাবপত্র বলিয়া উপহাস করিত এবং দেশের লোক রাইচরণের এইরুপ উন্মত্তবং আচরণে আশ্চর্য হইয়া গেল। ফেলনার যখন বিদ্যাভ্যাসের বয়স হইল তখন রাইচরণ নিজের জোতজমা সমস্ত বিক্রয় করিয়া ছেলেটিকে কলিকাতায় লইয়া গেল। সেখানে বহনকটে একটি চাকরি জোগাড় করিয়া ফেলনাকে বিদ্যালয়ে পাঠাইল। নিজে যেমন-তেমন করিয়া থাকিয়া ছেলেকে ভালো খাওয়া, ভালো পরা, ভালো শিক্ষা দিতে ক্ৰটি করিত না। মনে মনে