পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ ミミ গল্পগুচ্ছ ভাব করিয়া লইল; কেবল তাহার দাদার ঘরে একবারও প্রবেশ করিল না। ষে প্রৌঢ়া বিধবা তাহাদের বাড়িতে আসিয়া রাধিয়া দিয়া যায় সে আসিয়া যখন সকালে বংশীকে জিজ্ঞাসা করিল, “আজ কী রান্না হইবে”, বংশী তখন বিছানায় শ্যইয়া। সে বলিল, “আমার শরীর ভালো নাই, আজ আমি কিছু খাইব না— রসিককে ডাকিয়া তুমি খাওয়াইয়া দিয়ো।” সত্ৰীলোকটি বলিল, রসিক তাহাকে বলিয়াছে সে আজ বাড়িতে খাইবে না— অন্যত্র বোধ করি তাহার নিমন্ত্রণ আছে। শনিয়া বংশী দীঘনিশ্বাস ফেলিয়া গায়ের কাপড়টায় মাথা পৰ্যন্ত মুড়িয়া পাশ ফিরিয়া শুইল । রসিক যেদিন সন্ধ্যার পর গ্রাম ছাড়িয়া সাকাসের দলের সঙ্গে চলিয়া গেল সেদিন এমনি করিয়াই কাটিল। শীতের রাত্রি : আকাশে আধখানি চাঁদ উঠিয়াছে। সেদিন হাট সারিয়া সকলেই চলিয়া গিয়াছে— কেবল যাহাদের দরে পাড়ায় বাড়ি এখনো তাহারা মাঠের পথে কথা কহিতে কহিতে চলিয়াছে। একখানি বোঝাইশন্য গোরর গাড়িতে গাড়োয়ান র্যাপার মুড়ি দিয়া নিদ্রামান ; গোর দুটি আপন-মনে ধীরে ধীরে বিশ্রামশালার দিকে গাড়ি টানিয়া লইয়া চলিয়াছে। গ্রামের গোয়ালঘর হইতে খড়-জালানো ধোঁয়া বায়হীন শীতরাত্রে হিমভারাক্লান্ত হইয়া স্তরে স্তরে বশিঝাড়ের মধ্যে আবদ্ধ হইয়া আছে। রসিক যখন প্রান্তরের প্রান্তে গিয়া পৌছিল, যখন অসফট চন্দ্রালোকে তাহদের গ্রামের ঘন গাছগুলির নীলিমাও আর দেখা যায় না, তখন রসিকের মনটা কেমন করিয়া উঠিল। তখনো ফিরিয়া আসার পথ কঠিন ছিল না, কিন্তু তখনো তাহার হৃদয়ের কঠিনতা যায় নাই। উপাজ’ন করি না অথচ দাদার অন্ন খাই যেমন করিয়া হউক এ লাঞ্ছনা না মুছিয়া, নিজের টাকায় কেনা বাইসিকলে না চড়িযা আজন্মকালের এই গ্রামে আর ফিরিযা আসা চলিবে না – রহিল এখানকার চন্দনীদহের ঘাট, এখানকার সখেসাগর দিঘি, এখানকাব ফালগন মাসে সষে খেতের গন্ধ, চৈত্র মাসে আমবাগানে মৌমাছির গঞ্জেনধর্মনি : রহিল এখানকার বন্ধত্ব, এখানকার আমোদ-উৎসব— এখন সম্মুখে অপরিচিত পথিবী, অনাত্মীয় সংসার এবং ললাটে অদস্টের লিখন । 6. রসিক একমাত্র তাঁতের কাজেই যত অসুবিধা দেখিয়াছিল ; তাহার মনে হইত, আর-সকল কাজই ইহার চেয়ে ভালো। সে মনে করিয়াছিল, একবার তাহার সংকীর্ণ ঘরের বন্ধন ছেদন করিয়া বাহির হইতে পারিলেই তাহার কোনো ভাবনা নাই । তাই সে ভারি আনন্দে পথে বাহির হইয়াছিল। মাঝখানে যে কোনো বাধা, কোনো কন্ট, কোনো দীঘকালব্যয় আছে, তাহা তাহার মনেও হইল না। বাহিরে দাঁড়াইয়া দরের পাহাড়কেও যেমন মনে হয় অনতিদারে— যেমন মনে হয়, আধ ঘণ্টার পথ পার হইলেই বুঝি তাহার শিখরে গিয়া পেপছিতে পারা যায়-- তাহার গ্রামের বেস্টন হইতে বাহির হইবার সময় নিজের ইচ্ছার দলেভ সার্থকতাকে রসিকের তেমনি সহজগম্য এবং অত্যন্ত নিকটবতী বলিয়া বোধ হইল। কোথায় যাইতেছে, রসিক কাহাকেও তাহার কোনো খবর দিল না। একদিন স্বয়ং সে খবর বহন করিয়া আসিবে, এই তাহার পপ রহিল।