পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

や@S গল্পগুচ্ছ দরদের জায়গাটি যে কোথায় তাহা আমাদের সংসার বঝিয়া লইয়াছিল। বস্তুত, আমার বশর ব্রাহমও নন, খৃস্টানও নন, হয়তো বা নাস্তিকও না হইবেন। দেবাচনার কথা কোনোদিন তিনি চিন্তাও করেন নাই। মেয়েকে তিনি অনেক পড়াইয়াছেন-শনাইয়াছেন, কিন্তু কোনো দিনের জন্য দেবতা সম্বন্ধে তিনি তাহাকে কোনো উপদেশ দেন নাই। বনমালীবাব এ লইয়া তাঁহাকে একবার প্রশন করিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন, “আমি যাহা বুঝি না তাহা শিখাইতে গেলে কেবল কপটতা শেখানো হইবে।” অন্তঃপরে হৈমর একটি প্রকৃত ভক্ত ছিল, সে আমার ছোটো বোন নারানী। বউদিদিকে ভালোবাসে বলিয়া তাহাকে অনেক গঞ্জনা সহিতে হইয়াছিল। সংসারষাত্রায় হৈমর সমস্ত অপমানের পালা আমি তাহার কাছেই শুনিতে পাইতাম। এক দিনের জন্যও আমি হৈমর কাছে শনি নাই। এ-সব কথা সংকোচে সে মুখে আনিতে পারিত না । সে সংকোচ নিজের জন্য নহে। হৈম তাহার বাপের কাছ হইতে যত চিঠি পাইত সমস্ত আমাকে পড়িতে দিত। চিঠিগুলি ছোটো কিন্তু রসে ভরা। সেও বাপকে যত চিঠি লিখিত সমস্ত আমাকে দেখাইত। বাপের সঙ্গে তাহার সম্প্রবন্ধটিকে আমার সঙ্গে ভাগ করিয়া না লইলে তাহার দাম্পত্য যে পণ্য হইতে পারিত না। তাহার চিঠিতে শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে কোনো নালিশের ইশারাটাকুও ছিল না। থাকিলে বিপদ ঘটিতে পারিত। নারানীর কাছে শনিয়াছি, শ্বশুরবাড়ির কথা কী লেখে জানিবার জন্য মাঝে মাঝে তাহার চিঠি খোলা হইত। চিঠির মধ্যে অপরাধের কোনো প্রমাণ না পাইয়া উপরওয়ালাদের মন যে শান্ত হইয়াছিল তাহা নহে। বোধ করি তাহাতে তাঁহারা আশাভঙ্গের দুঃখই পাইয়াছিলেন। বিষম বিরক্ত হইয়া তাঁহারা বলিতে লাগিলেন, “এত ঘন ঘন চিঠিই বা কিসের জন্য। বাপই যেন সব, আমরা কি কেহ নই।” এই লইয়া অনেক অপ্রিয় কথা চলিতে লাগিল। আমি ক্ষুব্ধ হইয়া হৈমকে বলিলাম, “তোমার বাবার চিঠি আর-কাহাকেও না দিয়া আমাকেই দিয়ো। কলেজে যাইবার সময় আমি পোস্ট করিয়া দিব।" হৈম বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেন।” আমি লক্ষজায় তাহার উত্তর দিলাম না। বাড়িতে এখন সকলে বলিতে আরম্ভ করিল, “এইবার অপর মাথা খাওয়া হইল। বি. এ. ডিগ্রি শিকায় তোলা রহিল। ছেলেরই বা দোষ কণী ।” সে তো বটেই। দোষ সমস্তই হৈমর। তাহার দোষ যে তাহার বয়স সতেরো ; তাহার দোষ ষে আমি তাহাকে ভালোবাসি; তাহার দোষ যে বিধাতার এই বিধি, তাই আমার হাদয়ের রন্ধে রন্ধে সমস্ত আকাশ আজ বাঁশি বাজাইতেছে। বি.এ. ডিগ্রি অকাতরচিত্তে আমি চুলায় দিতে পারিতাম কিন্তু হৈমর কল্যাণে পণ করিলাম, পাস করিবই এবং ভালো করিয়াই পাস করিব। এ পণ রক্ষা করা আমার সে অবস্থায় যে সম্ভবপর বোধ হইয়াছিল তাহার দাইটি কারণ ছিল— এক তো হৈমর ভালোবাসার মধ্যে এমন একটি আকাশের বিস্তার ছিল যে, সংকীর্ণ আসক্তির মধ্যে সে মনকে জড়াইয়া রাখিত না, সেই ভালোবাসার চারি দিকে ভারি একটি স্বাস্থ্যকর হাওয়া বহিত। দ্বিতীয়, পরীক্ষার জন্য যে বইগুলি পড়ার