পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ももも গল্পগুচ্ছ গরের প্রতি আমার স্বামীর অজস্র ভক্তি আমাদের সংসারকে সব মৌচাকের ভিতরকার মধর মতো ভরিয়া রাখিয়াছিল। আমাদের আহারবিহার ধনজন সমস্তই এই ভক্তিতে ঠাসা ছিল, কোথাও ফাঁক ছিল না। আমি সেই রসে আমার সমস্ত মন লইয়া ডুবিয়া তবে সাত্বনা পাইয়াছি। তাই দেবতাকে আমার গরের রাপেই দেখিতে পাইলাম । তিনি আসিয়া আহার করিবেন এবং তার পর তাঁর প্রসাদ পাইব, প্রতিদিন সকালে ঘমে হইতে উঠিয়াই এই কথাটি মনে পড়িত, আর সেই আয়োজনে লাগিয়া যাইতাম। তাঁহার জন্য তরকারি কুটিতাম, আমার আঙুলের মধ্যে আনন্দধবনি বাজিত। ব্ৰাহরণ নই, তাঁহাকে নিজের হাতে রধিয়া খাওয়াইতে পারিতাম না, তাই আমার হৃদয়ের সব ক্ষধাটা মিটিত না। তিনি যে জ্ঞানের সমুদ্র, সে দিকে তো তাঁর কোনো অভাব নাই। আমি সামান্য রমণী, আমি তাঁহাকে কেবল একট খাওয়াইয়া-দাওয়াইয়া খুশি করিতে পারি, তাহাতেও এত দিকে এত ফাঁক ছিল । আমার গরে সেবা দেখিয়া আমার স্বামীর মন খুশি হইতে থাকিত এবং আমার উপরে তাঁহার ভক্তি আরও বাড়িয়া যাইত। তিনি যখন দেখিতেন আমার কাছে শাস্ত্রব্যাখ্যা করিবার জন্য গরের বিশেষ উৎসাহ, তখন তিনি ভাবিতেন, গরের কাছে বন্ধিহীনতার জন্য তিনি বরাবর আশ্রমধা পাইয়াছেন, তাঁহার সতী এবার বধির জোরে গরকে খুশি করিতে পারিল এই তাঁহার সৌভাগা। এমন করিয়া চার-পাঁচ বছর কোথা দিয়া যে কেমন করিয়া কাটিয়া গেল তাহা চোখে দেখিতে পাইলাম না। সমস্ত জীবনই এমনি করিয়া কাটিতে পারিত। কিন্তু, গোপনে কোথায় একটা চুরি চলিতেছিল, সেটা আমার কাছে ধরা পড়ে নাই, অন্তষামীর কাছে ধরা পড়িল । তার পর এক দিনে একটি মহতে সমস্ত উলটপালট হইয়া গেল। সেদিন ফালগুনের সকালবেলায় ঘাটে যাইবার ছায়াপথে সনান সারিয়া ভিজা কাপড়ে ঘরে ফিরিতেছিলাম। পথের একটি বাঁকে আমতলায় গরষ্ঠাকুরের সঙ্গে দেখা। তিনি কাঁধে একখানি গামছা লইয়া কোন-একটা সংস্কৃত মন্ত্র আবত্তি করিতে করিতে সনানে যাইতেছেন। ভিজা কাপড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়াতে লজ্জায় একট পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছি, এমন সময় তিনি আমার নাম ধরিয়া ডাকিলেন । আমি জড়োসড়ো হইয়া মাথা নিচু করিয়া দাঁড়াইলাম। তিনি আমার মাখের পরে দটি রাখিয়া বলিলেন, “তোমার দেহখানি সন্দের।” ডালে ডালে রাজ্যের পাখি ডাকিতেছিল, পথের ধারে ধারে ঝোপে-ঝাপে ভটি ফল ফটিয়াছে, আমের ডালে বোল ধরিতেছে। মনে হইল সমস্ত আকাশ-পাতাল পাগল হইয়া আলথাল হইয়া উঠিয়াছে। কেমন করিয়া বাড়ি গেলাম কিছু জ্ঞান নাই। একেবারে সেই ভিজা কাপড়েই ঠাকুরঘরে ঢাকিলাম, চোখে যেন ঠাকুরকে দেখিতে পাইলাম না—সেই ঘাটের পথের ছায়ার উপরকার আলোর চুমকিগালি আমার চোখের উপর কেবলই নাচিতে লাগিল। সেদিন গরে: আহার করিতে আসিলেন ; জিজ্ঞাসা করিলেন, "আন্দী নাই কেন।”