পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ পয়লা নশবর আমি তামাকটা পৰ্যন্ত খাই নে। আমার এক অভ্ৰভেদী নেশা আছে, তারই আওতায় অন্য-সকল নেশা একেবারে শিকড় পৰ্যন্ত শুকিয়ে মরে গেছে। সে আমার বই-পড়ার নেশা । আমার জীবনের মন্ত্রটা ছিল এই— যাবতজীবেং নাই-বা জীবেং ঋণং কৃত্বা বহিং পঠেৎ । যাদের বেড়াবার শখ বেশি অথচ পথেয়ের অভাব, তারা যেমন করে টাইমটেবল পড়ে, অলপ বয়সে আর্থিক অসম্প্ৰভাবের দিনে আমি তেমনি ক’রে বইয়ের ক্যাটালগ পড়তুম। আমার দাদার এক খড়শবশরে বাংলা বই বেরবা মাত্র নিবিচারে কিনতেন এবং তাঁর প্রধান অহংকার এই যে, সে বইয়ের একখানাও তাঁর আজ পর্যন্ত খোওয়া যায় নি। বোধ হয় বাংলাদেশে এমন সৌভাগ্য আর-কারও ঘটে না । কারণ, ধন বল, আয় বল, অন্যমনস্ক ব্যক্তির ছাতা বল, সংসারে যতকিছু সরণশীল পদার্থ আছে বাংলা বই হচ্ছে সকলের চেয়ে সেরা। এর থেকে বোঝা যাবে, দাদার খড়বশরের বইয়ের আলমারির চাবি দাদার খড়শাশুড়ির পক্ষেও দলভ ছিল। ‘দীন যথা রাজেন্দ্রসংগমে আমি যখন ছেলেবেলায় দাদার সঙ্গে তাঁর শ্বশুরবাড়ি যেতুম ঐ রন্ধবার আলমারিগুলোর দিকে তাকিয়ে সময় কাটিয়েছি। তখন আমার চক্ষর জিভে জল এসেছে। এই বললেই যথেষ্ট হবে, ছেলেবেলা থেকেই এত অসম্পভব-রকম বেশি পড়েছি যে পাস করতে পারি নি। যতখানি কম পড়া পাস করার পক্ষে অত্যাবশ্যক তার সময় আমার ছিল না । আমি ফেল-করা ছেলে বলে আমার একটা মস্ত সবিধে এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘড়ায় বিদ্যার তোলা জলে আমার স্নান নয়— স্রোতের জলে অবগাহনই আমার অভ্যাস । আজকাল আমার কাছে অনেক বি. এ. এম. এ. এসে থাকে ; তারা যতই আধুনিক হোক, আজও তারা ভিক্টোরীয় যাগের নজরবন্দী হয়ে বসে আছে। তাদের বিদ্যার জগৎ টলেমির পথিবীর মতো আঠারো-উনিশ শতাব্দীর সঙ্গে একেবারে যেন ইস্ক দিয়ে অটিা; বাংলাদেশের ছাত্রের দল পত্রপৌত্রাদিক্ৰমে তাকেই যেন চিরকাল প্রদক্ষিণ করতে থাকবে। তাদের মানস-রথযাত্রার গাড়িখানা বহন কটে মিল-বেন্থাম পেরিয়ে কালাইল-রাস্কিনে এসে কাত হয়ে পড়েছে। মাস্টার-মশায়ের বলির বেড়ার বাইরে তারা সাহস করে হাওয়া খেতে বেরোয় না । কিন্তু, আমরা যে-দেশের সাহিত্যকে খোঁটার মতো করে মনটাকে বেধে রেখে জাওর কাটাচ্ছি সে-দেশে সাহিত্যটা তো পথাণ নয়—সেটা সেখানকার প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে চলছে। সেই প্রাণটা আমার না থাকতে পারে কিন্তু সেই চলাটা আমি অনুসরণ করতে চেষ্টা করেছি। আমি নিজের চেষ্টায় ফরাসি জমীন ইটালিয়ান শিখে নিলাম: অলপদিন হল রাশিয়ান শিখতে শরে করেছিলাম। আধুনিকতার যে একসপ্রেস গাড়িটা ঘণ্টায় বাট মাইলের চেয়ে বেগে ছুটে চলেছে, আমি তারই টিকিট কিনেছি। তাই আমি হাকসলি-ডায়ারিনে এসেও ঠেকে যাই নি, টেনিসনকেও বিচার করতে ডরাই নে, এমন-কি, ইবসেন-মেটারলিকের নামের নৌকা ধরে আমাদের মাসিক