পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ ○O গল্পগুচ্ছ সাহিত্যে সঙ্গতা খ্যাতির বাঁধা কারবার চালাতে আমার সংকোচ বোধ হয় । আমাকেও কোনোদিন একদল মানুষ সন্ধান করে চিনে নেবে, এ আমার আশার অতীত ছিল। আমি দেখছি, বাংলাদেশে এমন ছেলেও দু-চারটে মেলে যারা কলেজও ছাড়ে না, অথচ কলেজের বাইরে সরস্বতীর যে বীণা বাজে তার ডাকেও উতলা হয়ে ওঠে। তারাই ক্ৰমে ক্ৰমে দটি-একটি করে আমার ঘরে এসে জন্টতে লাগল। এই আমার এক দ্বিতীয় নেশা ধরল— বকুনি। ভদ্রভাষায় তাকে আলোচনা বলা যেতে পারে। দেশের চারি দিকে সাময়িক ও অসাময়িক সাহিত্যে যে-সমস্ত কথাবাতা শনি তা এক দিকে এত কাঁচা, অন্য দিকে এত পরোনো যে মাঝে মাঝে তার হাফধরানো ভাপসা গমোটটাকে উদার চিন্তার খোলা হাওয়ায় কাটিয়ে দিতে ইচ্ছা করে। অথচ লিখতে কুড়েমি আসে। তাই মন দিয়ে কথা শোনে এমন লোকের নাগাল পেলে বেচে যাই । দল আমার বাড়তে লাগল। আমি থাকতুম আমাদের গলির দ্বিতীয় নম্বর বাড়িতে, এ দিকে আমার নাম হচ্ছে অদ্বৈতচরণ, তাই আমাদের দলের নাম হয়ে গিয়েছিল দ্বৈতাদ্বৈতসম্প্রদায়। আমাদের এই সম্প্রদায়ের কারও সময়-অসময়ের জ্ঞান ছিল না। কেউ-বা পাশ্চ-করা ট্রামের টিকিট দিয়ে পত্র-চিহ্নিত একখানা নতন-প্রকাশিত ইংরেজি বই হাতে করে সকালে এসে উপস্থিত— তক করতে করতে একটা বেজে যায়, তব তক শেষ হয় না। কেউ-বা সদা কলেজের নোট-নেওয়া খাতাখানা নিয়ে বিকেলে এসে হাজির, রাত যখন দুটো তখনো ওঠবার নাম করে না। আমি প্রায় তাদের খেতে বলি। কারণ, দেখেছি, সাহিত্যচর্চা যারা করে তাদের রসজ্ঞতার শক্তি কেবল মস্তিকে নয়, রসনাতেও খাব প্রবল। কিন্তু, যাঁর ভরসায় এই-সমস্ত ক্ষধিতদের যখন-তখন খেতে বলি তাঁর অবস্থা যে কী হয় সেটাকে আমি তুচ্ছ বলেই বরাবর মনে করে আসতুম | সংসারে ভাবের ও জ্ঞানের যে-সকল বড়ো বড়ো কুলালচক্র ঘরেছে, যাতে মানবসভ্যতা কতক-বা তৈরি হয়ে আগমনের পোড় খেয়ে শক্ত হয়ে উঠছে, কতক-বা কাঁচা থাকতে থাকতেই ভেঙে ভেঙে পড়ছে, তার কাছে ঘরকন্নার নড়াচড়া এবং রান্নাঘরের চুলোর আগন কি চোখে পড়ে। ভবানীর ভ্রাকৃটিভঙ্গী ভবই জানেন, এমন কথা কাব্যে পড়েছি। কিন্তু, ভবেব তিন চক্ষ: আমার একজোড়া মাত্র, তারও দটিশক্তি বই পড়ে পড়ে ক্ষীণ হয়ে গেছে। সতরাং, অসময়ে ভোজের আয়োজন করতে বললে আমার সীর প্রচাপে কিরকম চাপল্য উপস্থিত হত তা আমার নজরে পড়ত না। কমে তিনি বঝে নিয়েছিলেন, আমার ঘরে অসময়ই সময় এবং অনিয়মই নিয়ম। আমার সংসারের ঘড়ি তাল-কানা এবং আমার গহপথালির কোটরে কোটরে উনপঞ্চাশ পবনের বাসা। আমার যা-কিছ অর্থ সামথ তার একটিমাত্র খোলা ড্রেন ছিল, সে হচ্ছে বই-কেনার দিকে ; সংসারের অন্য প্রয়োজন হ্যাংলা কুকুরের মতো এই আমার শখের বিলিতি কুকুরের উছিষ্ট চেটে ও শীকে কেমন করে যে বেচে ছিল তার রহস্য আমার চেয়ে আমার স্মী বেশি জানতেন । নানা জ্ঞানের বিষয়ে কথা কওয়া আমার মতো লোকের পক্ষে নিতান্ত দরকার। বিদ্যা জাহির করবার জন্যে নয়, পরের উপকার করবার জন্যেও নয়; ওটা হচ্ছে কথা কয়ে কয়ে চিন্তা করা, জ্ঞান হজম করবার একটা ব্যারামপ্রণালী। আমি যদি লেখক হতুম,