পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পয়লা নশবর ●●● কিবা অধ্যাপক হতুম, তা হলে বকুনি আমার পক্ষে বাহুল্য হত। বাদের বাঁধা খাটনি আছে খাওয়া হজম করবার জন্যে তাদের উপায় খুজতে হয় না— যারা ঘরে বসে খায় তাদের অন্তত ছাতের উপর হন হন করে পায়চারি করা দরকার। আমার সেই দশা । তাই যখন আমার স্বৈতদলটি জমে নি তখন আমার একমাত্র দ্বৈত ছিলেন আমার সত্ৰী । তিনি আমার এই মানসিক পরিপাকের সশব্দ প্রক্লিয়া দীর্ঘকাল নিঃশব্দে বহন করেছেন । যদিচ তিনি পরতেন মিলের শাড়ি এবং তাঁর গয়নার সোনা খটি এবং নিরেট ছিল না, কিন্তু স্বামীর কাছ থেকে যে আলাপ শনতেন, সৌজাত্য-বিদ্যাই (Eugenics) বল, মেণ্ডেল-তত্ত্বই বল, আর গাণিতিক যুক্তিশাস্ত্রই বল, তার মধ্যে সঙ্গতা কিবা ভেজাল-দেওয়া কিছই ছিল না। আমার দলবদ্ধির পর হতে এই আলাপ থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন, কিন্তু সেজন্যে তাঁর কোনো নালিশ কোনোদিন শনি নি। আমার সন্ত্রীর নাম অনিলা। ঐ শব্দটার মানে কী তা আমি জানি নে, আমার খবশরেও যে জানতেন তা নয়। শব্দটা শুনতে মিষ্ট এবং হঠাৎ মনে হয়, ওর একটা-কোনো মানে আছে। অভিধানে যাই বলক, নামটার আসল মানে— আমার সতী তাঁর বাপের আদরের মেয়ে। আমার শাশুড়ি যখন আড়াই বছরের একটি ছেলে রেখে মারা যান তখন সেই ছোটো ছেলেকে যত্ন করবার মনোরম উপায়স্বরপে আমার বশর আর-একটি বিবাহ করেন। তাঁর উদ্দেশ্য যে কিরকম সফল হয়েছিল তা এই বললেই বোঝা যাবে যে, তাঁর মৃত্যুর দুদিন আগে তিনি অনিলার হাত ধরে বললেন, “মা, আমি তো যাচ্ছি, এখন সরোজের কথা ভাববার জন্যে তুমি ছাড়া আর কেউ রইল না।” তাঁর সন্ত্রী ও দ্বিতীয় পক্ষের ছেলেদের জন্যে কী ব্যবস্থা করলেন তা আমি ঠিক জানি নে। কিন্তু, আনিলার হাতে গোপনে তিনি তাঁর জমানো টাকা প্রায় সাড়ে সাত হাজার দিয়ে গেলেন । বললেন, “এ টাকা সদে খাটাবার দরকার নেই—নগদ খরচ করে এর থেকে তুমি সরোজের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দিয়ো ।” আমি এই ঘটনায় কিছু আশ্চৰ্য হয়েছিলাম। আমার বশর কেবল বন্ধিমান ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন যাকে বলে বিজ্ঞ। অর্থাৎ, ঝোঁকের মাথায় কিছুই করতেন না, হিসেব করে চলতেন । তাই তাঁর ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানষে করে তোলার ভার যদি কারও উপর তাঁর দেওয়া উচিত ছিল সেটা আমার উপর, এ বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল না। কিন্তু, তাঁর মেয়ে তাঁর জামাইয়ের চেয়ে যোগ্য, এমন ধারণা যে তাঁর কী করে হল তা তো বলতে পারি নে। অথচ টাকাকড়ি সম্প্রবন্ধে তিনি যদি আমাকে খুব খাঁটি বলে না জানতেন তা হলে আমার স্ত্রীর হাতে এত টাকা নগদ দিতে পারতেন না। আসল, তিনি ছিলেন ভিক্টোরীয় যাগের ফিলিসটাইন, আমাকে শেষ পর্যন্ত চিনতে পারেন নি। মনে মনে রাগ করে আমি প্রথমটা ভেবেছিলাম, এ সম্বন্ধে কোনো কথাই কব না। কথা কইও নি। বিশ্ববাস ছিল, কথা অনিলাকেই প্রথম কইতে হবে, এ সম্প্রবন্ধে আমার শরণাপন্ন না হয়ে তার উপায় নেই। কিন্তু অনিলা যখন আমার কাছে কোনো পরামশ* নিতে এল না তখন মনে করলাম, ও বাকি সাহস করছে না। শেষে একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলাম, “সরোজের পড়াশনের কী করছ।” অনিলা বললে, “মাস্টার রেখেছি, ইস্কুলেও যাচ্ছে।” আমি আভাস দিলাম, সরোজকে শেখাবার ভার আমি