পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ט ט মাতি ধরিয়া আমার চরণাগত হইত।— শুনিতেছ? কী মনে হইতেছে।" আমি সনিশবাসে বলিলাম, “মনে হইতেছে, শশিশেখর হইয়া জন্মিলে বেশ হইত।" “আগে সবটা শোনো। “একদিন বাদলার দিনে আমার জর হইয়াছে। ডাক্তার দেখিতে আসিয়াছেন। সেই প্রথম দেখা । “আমি জানলার দিকে মুখ করিয়া ছিলাম, সন্ধ্যার লাল আভাটা পড়িয়া রনে মখের বিবণতা যাহাতে দরে হয়। ডাক্তার যখন ঘরে ঢাকিয়াই আমার মাখের দিকে একবার চাহিলেন, তখন আমি মনে-মনে ডাক্তার হইয়া কল্পনায় নিজের মরখের দিকে চাহিলাম। সেই সন্ধ্যালোকে কোমল বালিশের উপরে একটি ঈষৎক্লিস্ট কুসুমপেলব মুখ; অসংযমিত চর্ণকুন্তল ললাটের উপর আসিয়া পড়িয়াছে এবং লক্ষজায় আনমিত বড়ো বড়ো চোখের পল্লব কপোলের উপর ছায়া বিস্তার করিয়াছে। "ডাক্তার নম্র মন্দস্বরে দাদাকে বলিলেন, একবার হাতটা দেখিতে হইবে । “আমি গাত্রাবরণের ভিতর হইতে ক্লান্ত সগোল হাতখানি বাহির করিয়া দিলাম। একবার হাতের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, যদি নীলবণ কাঁচের চুড়ি পরিতে পারিতাম তো আরও বেশ মানাইত। রোগীর হাত লইয়া নাড়ী দেখিতে ডাক্তারের এমন ইতস্তত ইতিপবে কখনো দেখি নাই। অত্যন্ত অসংলগ্নভাবে কল্পিত অঙ্গলিতে নাড়ী দেখিলেন, তিনি আমার জন্বরের উত্তাপ বুঝিলেন, আমিও তাঁহার অন্তরের নাড়ী কিরুপ চলিতেছে কতকটা আভাস পাইলাম।— বিশ্ববাস হইতেছে না ?” আমি বলিলাম, “অবিশ্বাসের কোনো কারণ দেখিতেছি না— মানুষের নাড়ী সকল অবসথায় সমান চলে না ।” “কালক্ৰমে আরও দুই-চারিবার রোগ ও আরোগ্য হইবার পরে দেখিলাম, আমার সেই সন্ধ্যাকালের মানস-সভায় পথিবীর কোটি কোটি পরিষে-সংখ্যা অত্যন্ত হ্রাস হইয়া ক্ৰমে একটিতে আসিয়া ঠেকিল, আমার পথিবী প্রায় জনশন্য হইয়া আসিল । জগতে কেবল একটি ডাক্তার এবং একটি রোগী অবশিষ্ট রহিল। “আমি গোপনে সন্ধ্যাবেলায় একটি বাসন্তী রঙের কাপড় পরিতাম, ভালো করিয়া খোঁপা বধিয়া মাথায় একগাছি বেলফলের মালা জড়াইতাম, একটি আয়না হাতে লইয়া বাগানে গিয়া বসিতাম । “কেন। আপনাকে দেখিয়া কি আর পরিতৃপিত হয় না। বাস্তবিকই হয় না । কেননা, আমি তো আপনি আপনাকে দেখিতাম না। আমি তখন একলা বসিয়া দুইজন হইতাম। আমি তখন ডাক্তার হইয়া আপনাকে দেখিতাম, মুগ্ধ হইতাম এবং ভালোবাসিতাম এবং আদর করিতাম, অথচ প্রাণের ভিতরে একটা দীঘনিশ্ববাস সন্ধাবাতাসের মতো হহে করিয়া উঠিত। “সেই হইতে আমি আর একলা ছিলাম না । যখন চলিতাম নতনেত্ৰে চাহিয়া দেখিতাম পায়ের অঙ্গ-লিগুলি পথিবীর উপরে কেমন করিয়া পড়িতেছে, এবং ভাবিতাম এই পদক্ষেপ আমাদের নতন-পরীক্ষোত্তীর্ণ ডাঙ্কারের কেমন লাগে। মধ্যাহে জানলার বাহিরে ঝাঁ-ঝাঁ করিত, কোথাও সাড়াশব্দ নাই, মাঝে-মাঝে একএকটা চিল অতিদর আকাশে শব্দ করিয়া উড়িয়া যাইত; এবং আমাদের উদ্যানপ্রাচীরের বাহিরে খেলেনাওয়ালা সরে ধরিয়া চাই খেলেনা চাই চুড়ি চাই করিয়া