পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bf8 গল্পগুচ্ছ একরাত্রি সরবালার সঙ্গে একত্রে পাঠশালায় গিয়াছি, এবং বউ-বউ খেলিয়াছি। তাহাদের বাড়িতে গেলে সরবালার মা আমাকে বড়ো যত্ন করিতেন এবং আমাদের দুইজনকে একত্র করিয়া আপনা-আপনি বলাবলি করিতেন, “আহা, দটিতে বেশ মানায়।” ছোটো ছিলাম, কিন্তু কথাটার অর্থ একরকম বুঝিতে পারিতাম। সরবালার প্রতি যে সবসাধারণের অপেক্ষা আমার কিছু বিশেষ দাবি ছিল, সে ধারণা আমার মনে বন্ধমলে হইয়া গিয়াছিল। সেই অধিকারমদে মত্ত হইয়া তাহার প্রতি যে আমি শাসন এবং উপদ্রব না করিতাম তাহা নহে। সেও সহিষ্ণভাবে আমার সকলরকম ফরমাশ খাটিত এবং শাসিত বহন করিত। পাড়ায় তাহার রাপের প্রশংসা ছিল, কিন্তু ববর বালকের চক্ষে সে সৌন্দয্যের কোনো গৌরব ছিল না— আমি কেবল জানিতাম, সরবালা আমারই প্রভুত্ব স্বীকার করিবার জন্য পিতৃগহে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, এইজন্য সে আমার বিশেষরপ অবহেলার পাত্র। আমার পিতা চৌধুরী-জমিদারের নায়েব ছিলেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল, আমার হাতটা পাকিলেই আমাকে জমিদারি-সেরেস্তার কাজ শিখাইয়া একটা কোথাও গোমস্তাগিরিতে প্রবত্ত করাইয়া দিবেন। কিন্তু, আমি মনে মনে তাহাতে নারাজ ছিলাম। আমাদের পাড়ার নীলরতন যেমন কলিকাতায় পালাইয়া লেখাপড়া শিখিয়া কালেক্টর সাহেবের নাজির হইয়াছে, আমারও জীবনের লক্ষ্য সেইরুপ অত্যুচ্চ ছিল— কালেক্টরের নাজির না হইতে পারি তো জজ-আদালতের হেডক্লাক হইব, ইহা আমি মনে-মনে নিশ্চয় সিথর করিয়া রাখিয়াছিলাম । সবাদাই দেখিতাম, আমার বাপ উক্ত আদালতজীবৗদিগকে অত্যন্ত সম্মান করিতেন— নানা উপলক্ষে মাছটা-তরকারিটা টাকাটা-সিকেটা লইয়া যে তাঁহাদের পজাচনা করিতে হইত তাহাও শিশুকাল হইতে আমার জানা ছিল ; এইজনা আদালতের ছোটো কর্মচারী এমন-কি পেয়াদাগলোকে পর্যন্ত হৃদয়ের মধ্যে খব একটা সম্প্রমের আসন দিয়াছিলাম। ইহারা আমাদের বাংলাদেশের পজা দেবতা; তেত্ৰিশ কোটির ছোটো ছোটো নতন সংস্করণ। বৈষয়িক সিন্ধিলাভ সম্বন্ধে স্বয়ং সিদ্ধিদাতা গণেশ অপেক্ষা ইহাদের প্রতি লোকের আন্তরিক নিভার ঢের বেশি ; সতরাং পশ্চাবে গণেশের যাহা-কিছু পাওনা ছিল আজকাল ইহারাই তাহা সমস্ত পাইয়া থাকেন । আমিও নীলরতনের দশটান্তে উৎসাহিত হইয়া এক সময় বিশেষ সবিধাযোগে কলিকাতায় পালাইয়া গেলাম। প্রথমে গ্রামের একটি আলাপী লোকের বাসায় ছিলাম, তাহার পরে বাপের কাছ হইতেও কিছ কিছ: অধ্যয়নের সাহায্য পাইতে লাগিলাম। লেখাপড়া যথানিয়মে চলিতে লাগিল। ইহার উপরে আবার সভাসমিতিতেও যোগ দিতাম। দেশের জন্য হঠাৎ প্রাণবিসজন করা যে আশা আবশ্যক, এ সম্বন্ধে আমার সন্দেহ ছিল না। কিন্তু কী করিয়া উত্ত দুঃসাধ্য কাজ করা যাইতে পারে আমি জানিতাম না, এবং কেহ দান্টান্তও দেখাইত না। কিন্তু, তাহা বলিয়া উৎসাহের কোনো ত্রটি ছিল না। আমরা পাড়াগেয়ে ছেলে,