পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১১৮

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

হঠাৎ মনে হয় না। সে যেন কাহারও নাম মুখে আনিতে পারে না, আভাস দিতে গেলেও কুণ্ঠিত হইয়া পড়ে। এই-যে আলোচনা করিতেছে ইহার জন্য সে যেন কাহার প্রতি অপরাধ অনুভব করিতেছে। ইহা অন্যায়, ইহা অপমান- কিন্তু, আজ এই নির্জন রাত্রে, নিস্তব্ধ আকাশে, বন্ধুর পাশে বসিয়া এ অন্যায়টুকু সে কোনোমতেই কাটাইতে পারিল না।

 সে কী মুখ! প্রাণের আভা তাহার কপোলের কোমলতার মধ্যে কী সুকুমার ভাবে প্রকাশ পাইতেছে। হাসিতে তাহার অন্তঃকরণ কী আশ্চর্য আলোর মতো ফুটিয়া পড়ে! ললাটে কী বুদ্ধি! এবং ঘন পল্লবের ছায়া- তলে দুই চক্ষুর মধ্যে কী নিবিড় অনির্বচনীয়তা। আর, সেই দুটি হাত- সেবা এবং স্নেহকে সৌন্দর্যে সার্থক করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে, সে যেন কথা কহিতেছে। বিনয় নিজের জীবনকে যৌবনকে ধন্য জ্ঞান করিতেছে, এই আনন্দে তাহার বুকের মধ্যে যেন ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতেছে। পৃথিবীর অধিকাংশ লোকই যাহা না দেখিয়াই জীবন সাঙ্গ করে, বিনয় যে তাহাকে এমন করিয়া চোখের সামনে মূর্তিমান দেখিতে পাইবে ইহার চেয়ে আশ্চর্য কিছুই নাই।

 কিন্তু, এ কী পাগলামি! এ কী অন্যায়! হোক অন্যায়, আর তো ঠেকাইয়া রাখা যায় না। এই স্রোতেই যদি কোনো একটা কূলে তুলিয়া দেয় তো ভালো; আর যদি ভাসাইয়া দেয়, যদি তলাইয়া লয়, তবে উপায় কী? মুশকিল এই যে, উদ্ধারের ইচ্ছাও হয় না- এতদিনকার সমস্ত সংস্কার, সমস্ত স্থিতি, হারাইয়া চলিয়া যাওয়াই যেন জীবনের সার্থক পরিণাম।

 গোরা চুপ করিয়া শুনিতে লাগিল। এই ছাতে এমনি নির্জন নিষুপ্ত জ্যোৎস্নারাত্রে আরও অনেক দিন দুই জনে অনেক কথা হইয়া গেছে- কত সাহিত্য, কত লোকচরিত্র, কত সমাজহিতের আলোচনা ভবিষ্যৎ জীবন- যাত্রা সম্বন্ধে দুই জনের কত সংকল্প; কিন্তু এমন কথা ইহার পূর্বে আর- কোনোদিন হয় নাই। মানবহৃদয়ের এমন একটা সত্য পদার্থ, এমন একটা প্রবল প্রকাশ এমন করিয়া গোরার সামনে আসিয়া পড়ে নাই। এই-সমস্ত

১০৮