পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২০

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

নইলে সত্যকেই পাব না। তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে সত্যের যে মূর্তিকে প্রত্যক্ষ করছ আমি সেখানে সে মূর্তিকে অভিবাদন করতে যেতে পারব না— তা হলে আমার জীবনের সত্যকে হারাতে হবে। হয় এ দিক, নয় ও দিক।”

 বিনয় কহিল, “হয় বিনয়, নয় গোরা। আমি নিজেকে ভরে নিতে দাঁড়িয়েছি, তুমি নিজেকে ত্যাগ করতে দাঁড়িয়েছ।”

 গোরা অসহিষ্ণু হইয়া কহিল, “বিনয়, তুমি মুখে মুখে বই রচনা কোরো না। তোমার কথা শুনে আমি একটা কথা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি, তোমার জীবনে তুমি আজ একটা প্রবল সত্যের সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছ— তার সঙ্গে ফাঁকি চলে না। সত্যকে উপলব্ধি করলেই তার কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হবে— সে আর থাকবার জো নেই। আমি যে ক্ষেত্রে দাঁড়িয়েছি সেই ক্ষেত্রের সত্যকেও অমনি করেই একদিন আমি উপলব্ধি করব এই আমার আকাঙক্ষা। তুমি এতদিন বই-পড়া প্রেমের পরিচয়েই পরিতৃপ্ত ছিলে— আমিও বই-পড়া স্বদেশপ্রেমকেই জানি। প্রেম আজ তোমার কাছে যখনই প্রত্যক্ষ হল তখনই বুঝতে পেরেছ বইয়ের জিনিসের চেয়ে এ কত সত্য— এ তোমার সমস্ত জগৎ-চরাচর অধিকার করে বসেছে, কোথাও তুমি এর কাছ থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছ না। স্বদেশপ্রেম যেদিন আমার সম্মুখে এমনি সর্বাঙ্গীণভাবে প্রত্যক্ষগোচর হবে সেদিন আমারও আর রক্ষা নেই। সেদিন সে আমার ধনপ্রাণ, আমার অস্থিমজ্জারক্ত, আমার আকাশ-আলোক, আমার সমস্তই অনায়াসে আকর্ষণ করে নিতে পারবে। স্বদেশের সেই সত্যমূর্তি যে কী আশ্চর্য অপরূপ, কী সুনিশ্চিত সুগোচর, তার আনন্দ তার বেদনা যে কী প্রচণ্ড প্রবল, যা বন্যার স্রোতের মতো জীবন-মৃত্যুকে এক মুহূর্তে লঙ্ঘন করে যায়, তা আজ তোমার কথা শুনে মনে মনে অল্প অল্প অনুভব করতে পারছি। তোমার জীবনের এই অভিজ্ঞতা আমার জীবনকে আজ আঘাত করেছে— তুমি যা পেয়েছ তা আমি কোনোদিন বুঝতে পারব কি না জানি না, কিন্তু আমি যা পেতে চাই তার আস্বাদ যেন তোমার ভিতর দিয়েই আমি অনুভব করছি।”

১১০