পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২১

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 বলিতে বলিতে গোরা মাদুর ছাড়িয়া উঠিয়া ছাতে বেড়াইতে লাগিল। পূর্বদিকের উষার আভাস তাহার কাছে যেন একটা বাক্যের মতে, বার্তার মতো প্রকাশ পাইল; যেন প্রাচীন তপোবনের একটা বেদমন্ত্রের মতো উচ্চারিত হইয়া উঠিল; তাহার সমস্ত শরীরে কাটা দিল— মুহূর্তের জন্য সে স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল এবং ক্ষণ কালের জন্য তাহার মনে হইল, তাহার ব্রহ্মরন্ধ ভেদ করিয়া একটি জ্যোতিলেখা স্বক্ষ মুণালের দ্যায় উঠিয়া একটি জ্যোতির্ময় শতদলে সমস্ত আকাশে পরিব্যাপ্ত হইয়া বিকশিত হইল— তাহার সমস্ত প্রাণ, সমস্ত চেতনা, সমস্ত শক্তি যেন ইহাতে একেবারে পরম আনন্দে নিঃশেষিত হইয়া গেল।

 গোরা যখন আপনাতে আপনি ফিরিয়া আসিল তখন সে হঠাৎ বলিয়া উঠিল, “বিনয়, তোমার এ প্রেমকেও পার হয়ে আসতে হবে— আমি বলছি, ওখানে থামলে চলবে না। আমাকে যে মহাশক্তি আহ্বান করছেন তিনি যে কতবড়ো সত্য একদিন তোমাকে আমি তা দেখাব। আমার মনের মধ্যে আজ ভারি আনন্দ হচ্ছে— তোমাকে আজ আমি আর-কারও হাতে ছেড়ে দিতে পারব না।”

 বিনয় মাদুর ছাড়িয়া উঠিয়া গোরার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। গোরা তাহাকে একটা অপূর্ব উৎসাহে দুই হাত দিয়া বুকে চাপিয়া ধরিল; কহিল, “ভাই বিনয়, আমরা মরব, এক মরণে মরব— আমরা দুজনে এক; আমাদের কেউ বিচ্ছিন্ন করবে না, কেউ বাধা দিতে পারবে না।”

 গোরার এই গভীর উৎসাহের বেগ বিনয়েরও হৃদয়ের মধ্যে তরঙ্গিত হইয়া উঠিল; সে কোনো কথা না বলিয়া গোরার এই আকর্ষণে আপনাকে ছাড়িয়া দিল।

 গোরা বিনয় দুই জনে নীরবে পাশাপাশি বেড়াইতে লাগিল। পূর্বাকাশ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। গোরা কহিল, “ভাই, আমার দেবীকে আমি যেখানে দেখতে পাচ্ছি সে তো সৌন্দর্যের মাঝখানে নয়— সেখানে দুর্ভিক্ষ দারিদ্র্য, সেখানে কষ্ট আর অপমান। সেখানে গান গেয়ে, ফুল দিয়ে পুজো নয়;

১১১