পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২২

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

সেখানে প্রাণ দিয়ে, রক্ত দিয়ে পুজো করতে হবে— আমার কাছে সেইটেই সব চেয়ে বড়ো আনন্দ মনে হচ্ছে— সেখানে সুখ দিয়ে ভোলাবার কিছু নেই —সেখানে নিজের জোরে সম্পূর্ণ জাগতে হবে, সম্পূর্ণ দিতে হবে— মাধুর্য নয়, এ একটা দুর্জয় দুঃসহ আবির্ভাব— এ নিষ্ঠুর, এ ভয়ংকর— এর মধ্যে সেই কঠিন ঝংকার আছে যাতে করে সপ্ত স্বর এক সঙ্গে বেজে উঠে তার ছিঁড়ে পড়ে যায়। মনে করলে আমার বুকের মধ্যে উল্লাস জেগে ওঠে-আমার মনে হয়, এই আনন্দই পুরুষের আনন্দ– এই হচ্ছে জীবনের তাণ্ডবনৃত্য— পুরাতনের প্রলয়যজ্ঞের আগুনের শিখার উপরে নূতনের অপরূপ মূর্তি দেখবার জন্যই পুরুষের সাধনা। রক্তবর্ণ আকাশক্ষেত্রে একটা বন্ধনমুক্ত জ্যোতির্ময় ভবিষ্যৎকে দেখতে পাচ্ছি— আজকেকার এই আসন্ন প্রভাতের মধ্যেই দেখতে পাচ্ছি— দেখো, আমার বুকের ভিতরে কে ডমরু বাজাচ্ছে।”

 বলিয়া বিনয়ের হাত লইয়া গোরা নিজের বুকের উপরে চাপিয়া ধরিল। বিনয় কহিল, “ভাই গোরা, আমি তোমার সঙ্গেই যাব। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি, আমাকে কোনো দিন তুমি দ্বিধা করতে দিয়ে না। একেবারে ভাগ্যের মতো নির্দয় হয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যেয়ো। আমাদের দুই জনের এক পথ, কিন্তু আমাদের শক্তি তো সমান নয়।”

 গোরা কহিল, “আমাদের প্রকৃতির মধ্যে ভেদ আছে, কিন্তু একটা মহৎ আনন্দে আমাদের ভিন্ন প্রকৃতিকে এক করে দেবে— তোমাতে আমাতে যে ভালোবাসা আছে তার চেয়ে বড়ো প্রেমে আমাদের এক করে দেবে। সেই প্রেম যত ক্ষণে সত্য না হবে তত ক্ষণে আমাদের দুজনের মধ্যে পদে পদে অনেক আঘাত-সংঘাত বিরোধ-বিচ্ছেদ ঘটতে থাকবে— তার পরে একদিন আমরা সমস্ত ভুলে গিয়ে, আমাদের পার্থক্যকে, আমাদের বন্ধুত্বকেও ভুলে গিয়ে, একটা প্রকাগু, একটা প্রচণ্ড আত্মপরিহারের মধ্যে আটল বলে মিলে গিয়ে দাড়াতে পারব— সেই কঠিন আনন্দই আমাদের বন্ধুত্বের শেষ পরিণাম হবে।”

 বিনয় গোরার হাত ধরিয়া কহিল, “তাই হোক।”

১১২