পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৩৯

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

বাণিজ্যতরীর পিছনে চিরকাল শিকল দিয়ে বেঁধে নিয়ে বেড়াতে পারবে না। এই কথা মনে দৃঢ় রেখে প্রতিদিনই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার জন্য ভবিষ্যতের কোন্‌-এক তারিখে লড়াই আরম্ভ হবে তোমরা তারই উপর বরাত দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে আছ। আমি বলছি, লড়াই আরম্ভ হয়েছে, প্রতি মুহূর্তে লড়াই চলছে, এ সময়ে যদি তোমরা নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারো তা হলে তার চেয়ে কাপুরুষতা তোমাদের কিছুই হতে পারে না।

 বিনয় কহিল, “দেখো গোরা, তোমার সঙ্গে আমাদের একটা প্রভেদ আমি এই দেখতে পাই যে, পথে ঘাটে আমাদের দেশে প্রতিদিন যা ঘটছে এবং অনেক দিন ধরেই যা ঘটে আসছে তুমি প্রত্যহই তাকে যেন নূতন চোখে দেখতে পাও। নিজের নিশ্বাসপ্রশ্বাসকে আমরা যেমন ভুলে থাকি এগুলোও আমাদের কাছে তেমনি— এতে আমাদের আশাও দেয় না হতাশও করে না, এতে আমাদের আনন্দ নেই দুঃখও নেই— দিনের পর দিন অত্যন্ত শূন্যভাবে চলে যাচ্ছে, চারি দিকের মধ্যে নিজেকে এবং নিজের দেশকে অনুভবমাত্র করছি নে।”

 হঠাৎ গোরার মুখ রক্তবর্ণ হইয়া তাহার কপালের শিরাগুলা ফুলিয়া উঠিল— সে দুই হাত মুঠা করিয়া রাস্তার মাঝখানে এক জুড়িগাড়ির পিছনে ছুটিতে লাগিল এবং বজ্রগর্জনে সমস্ত রাস্তার লোককে চকিত করিয়া চীৎকার করিল, “থামাও গাড়ি!” একটা মোটা ঘড়ির চেন-পরা বাবু গাড়ি হাঁকাইতেছিল, সে একবার পিছন ফিরিয়া দেখিয়া দুই তেজস্বী ঘোড়াকে চাবুক কষাইয়া মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেল।

 একজন বৃদ্ধ মুসলমান মাথায় এক-ঝাঁকা ফল সবজি আণ্ডা রুটি মাখন প্রভৃতি আহার্যসামগ্রী লইয়া কোনো ইংরেজ প্রভুর পাকশালার অভিমুখে চলিতেছিল। চেন-পরা বাবুটি তাহাকে গাড়ির সম্মুখ হইতে সরিয়া যাইবার জন্য হাঁকিয়াছিল, বৃদ্ধ শুনিতে না পাওয়াতে গাড়ি প্রায় তাহার ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়ে। কোনোমতে তাহার প্রাণ বাঁচিল কিন্তু ঝাঁকাসমেত

১২৯