পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আত্মবিস্মৃত হইয়াই গোরাকে নিরীক্ষণ করিতেছিল। গোরা তাহার বলিষ্ঠ দুই বাহু টেবিলের উপরে রাখিয়া সম্মুখে ঝুঁকিয়া বসিয়াছিল; তাহার প্রশস্ত শুভ্র ললাটের উপর বাতির আলো পড়িয়াছে; তাহার মুখে কখনো অবজ্ঞার হাস্য কখনো বা ঘৃণার ভ্রূকুটি তরঙ্গিত হইয়া উঠিতেছে; তাহার মুখের প্রত্যেক ভাবলীলায় একটা আত্মমর্যাদার গৌরব লক্ষিত হইতেছে; সে যাহা বলিতেছে তাহা যে কেবলমাত্র সাময়িক বিতর্ক বা আক্ষেপের কথা নহে, প্রত্যেক কথা যে তাহার অনেক দিনের চিন্তা এবং ব্যবহারের দ্বারা নিঃসন্দিগ্ধরূপে গঠিত হইয়া উঠিয়াছে এবং তাহার মধ্যে যে কোনোপ্রকার দ্বিধা-দুর্বলতা বা আকস্মিকতা নাই তাহা কেবল তাহার কণ্ঠস্বরে নহে, তাহার মুখে এবং তাহার সমস্ত শরীরেই যেন সুদৃঢ়ভাবে প্রকাশ পাইতেছে। সুচরিতা তাহাকে বিস্মিত হইয়া দেখিতে লাগিল। সুচরিতা তাহার জীবনে এত দিন পরে এই প্রথম একজনকে একটি বিশেষ মানুষ একটি বিশেষ পুরুষ বলিয়া যেন দেখিতে পাইল। তাহাকে আর দশজনের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিতে পারিল না। এই গোরার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া হারানবাবু অকিঞ্চিৎকর হইয়া পড়িলেন। তাঁহার শরীরের এবং মুখের আকৃতি, তাঁহার হাব-ভাব-ভঙ্গি, এমন-কি, তাঁহার জামা এবং চাদরখানা পর্যন্ত যেন তাঁহাকে ব্যঙ্গ করিতে লাগিল। এতদিন বারম্বার বিনয়ের সঙ্গে গোরার সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া সুচরিতা গোরাকে একটা বিশেষ দলের একটা বিশেষ মতের অসামান্য লোক বলিয়া মনে করিয়াছিল, তাহার দ্বারা দেশের একটা কোনো বিশেষ মঙ্গল-উদ্দেশ্য সাধিত হইতে পারে এইমাত্র সে কল্পনা করিয়াছিল— আজ সুচরিতা তাহার মুখের দিকে একমনে চাহিতে চাহিতে সমস্ত দল, সমস্ত মত, সমস্ত উদ্দেশ্য হইতে পৃথক করিয়া গোরাকে কেবল গোরা বলিয়াই যেন দেখিতে লাগিল। চাঁদকে সমুদ্র যেমন সমস্ত প্রয়োজন সমস্ত ব্যবহারের অতীত করিয়া দেখিয়াই অকারণে উদ্‌বেল হইয়া উঠিতে থাকে, সুচরিতার অন্তঃকরণ আজ তেমনি সমস্ত ভুলিয়া, তাহার সমস্ত বুদ্ধি ও সংস্কার, তাহার সমস্ত জীবনকে অতিক্রম করিয়া যেন চতুর্দিকে

১৬৪