পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সারিয়া ঘটিতে গঙ্গাজল লইয়া নামাবলী গায়ে দিয়া মনে মনে মন্ত্র জপ করিতে করিতে ঘরে চলিয়াছিলেন। গোরা একেবারে তাঁহার ঘাড়ের উপর গিয়া পড়িল। লজ্জিত হইয়া গোরা তাড়াতাড়ি তাঁহার পা ছুঁইয়া প্রণাম করিল। তিনি শশব্যস্ত হইয়া “থাক্‌ থাক্‌' বলিয়া সসংকোচে চলিয়া গেলেন। পূজায় বসিবার পূর্বে গোরার স্পর্শে তাঁহার গঙ্গাস্নানের ফল মাটি হইল। কৃষ্ণদয়াল যে গোরার সংস্পর্শই বিশেষ করিয়া এড়াইয়া চলিবার চেষ্টা করিতেন গোরা তাহা ঠিক বুঝিত না; সে মনে করিত শুচিবায়ুগ্রস্ত বলিয়া সর্বপ্রকারে সকলেরই সংস্রব বাঁচাইয়া চলাই অহরহ তাঁহার সতর্কতার একমাত্র লক্ষ্য ছিল; আনন্দময়ীকে তো তিনি ম্লেচ্ছ বলিয়া দূরে পরিহার করিতেন— মহিম কাজের লোক, মহিমের সঙ্গে তাঁহার দেখা সাক্ষাতেরই অবকাশ ঘটিত না। সমস্ত পরিবারের মধ্যে কেবল মহিমের কন্যা শশিমুখীকে তিনি কাছে লইয়া তাহাকে সংস্কৃত স্তোত্র মুখস্থ করাইতেন এবং পূজার্চনাবিধিতে দীক্ষিত করিতেন।

 কৃষ্ণদয়াল গোরাকর্তৃক তাঁহার পাদস্পর্শে ব্যস্ত হইয়া পলায়ন করিলে পর তাঁহার সংকোচের কারণ সম্বন্ধে গোরার চেতনা হইল এবং সে মনে মনে হাসিল। এইরূপে পিতার সহিত গোরার সমস্ত সম্বন্ধ প্রায় বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল এবং মাতার অনাচারকে সে যতই নিন্দা করুক এই আচারদ্রোহিনী মাকেই গোরা তাহার জীবনের সমস্ত ভক্তি সমর্পণ করিয়া পূজা করিত।

 আহারান্তে গোরা একটি ছোটো পুঁটলিতে গোটাকয়েক কাপড় লইয়া সেটা বিলাতি পর্যটকদের মতো পিঠে বাঁধিয়া মার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল। কহিল, “মা, আমি কিছুদিনের মতো বেরোব।”

 আনন্দময়ী কহিলেন, “কোথায় যাবে বাবা?”

 গোরা কহিল, “সেটা আমি ঠিক বলতে পারছি নে।”

 আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোনো কাজ আছে?”

 গোরা কহিল, “কাজ বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছু নয়— এই যাওয়াটাই একটা কাজ।”

১৮০