পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সমস্ত আয়োজনকে বিপর্যস্ত করিয়া দিয়া বিনয় অকারণে পলাতক হইবে কী বলিয়া? সময়ও আর অধিক নাই; এবং নিজের একটা নূতন নৈপুণ্য আবিষ্কার করিয়া সে নিজেই এই কাজে উৎসাহিত হইয়া উঠিয়াছে।

 অবশেষে ললিতা বরদাসুন্দরীকে কহিল, “আমি এতে থাকব না।”

 বরদাসুন্দরী তাঁহার মেজো মেয়েকে বেশ চিনিতেন, তাই নিতান্ত শঙ্কিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন?”

 ললিতা কহিল, “আমি যে পারি নে।”

 বস্তুত যখন হইতে বিনয়কে আর আনাড়ি বলিয়া গণ্য করিবার উপায় ছিল না, তখন হইতেই ললিতা বিনয়ের সম্মুখে কোনোমতেই আবৃত্তি বা অভিনয় অভ্যাস করিতে চাহিত না। সে বলিত, “আমি আপনি আলাদা অভ্যাস করিব।' ইহাতে সকলেরই অভ্যাসে বাধা পড়িত, কিন্তু ললিতাকে কিছুতেই পারা গেল না। অবশেষে, হার মানিয়া অভ্যাসক্ষেত্রে ললিতাকে বাদ দিয়াই কাজ চালাইতে হইল।

 কিন্তু যখন শেষ অবস্থায় ললিতা একেবারেই ভঙ্গ দিতে চাহিল তখন বরদাসুন্দরীর মাথায় বজ্রাঘাত হইল। তিনি জানিতেন যে তাঁহার দ্বারা ইহার প্রতিকার হইতেই পারিবে না। তখন তিনি পরেশবাবুর শরণাপন্ন হইলেন। পরেশবাবু সামান্য বিষয়ে কখনোই তাঁহার মেয়েদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় হস্তক্ষেপ করিতেন না। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তাঁহারা প্রতিশ্রুত হইয়াছেন, সেই অনুসারে সে পক্ষও আয়োজন করিয়াছেন, সময়ও অত্যন্ত সংকীর্ণ, এই-সমস্ত বিবেচনা করিয়া পরেশবাবু ললিতাকে ডাকিয়া তাহার মাথায় হাত দিয়া কহিলেন, “ললিতা, এখন তুমি ছেড়ে দিলে যে অন্যায় হবে।”

 ললিতা রুদ্ধরোদন কণ্ঠে কহিল, “বাবা, আমি যে পারি নে। আমার হয় না।”

 পরেশ কহিলেন, “তুমি ভালো না পারলে তোমার অপরাধ হবে না, কিন্তু না করলে অন্যায় হবে।”

 ললিতা মুখ নিচু করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল; পরেশবাবু কহিলেন, “মা, যখন

২০২