পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তুমি ভার নিয়েছ তখন তোমাকে তো সম্পন্ন করতেই হবে। পাছে অহংকারে ঘা লাগে বলে আর তো পালাবার সময় নেই। লাগুক-না ঘা, সেটাকে অগ্রাহ্য করেও তোমাকে কর্তব্য করতে হবে। পারবে না মা?”

 ললিতা পিতার মুখের দিকে মুখ তুলিয়া কহিল, “পারব।”

 সেইদিনই সন্ধ্যাবেলায় বিশেষ করিয়া বিনয়ের সম্মুখেই সমস্ত সংকোচ সম্পূর্ণ দূর করিয়া সে যেন একটা অতিরিক্ত বলের সঙ্গে, যেন স্পর্ধা করিয়া নিজের কর্তব্যে প্রবৃত্ত হইল। বিনয় এতদিন তাহার আবৃত্তি শোনে নাই। আজ শুনিয়া আশ্চর্য হইল। এমন সুস্পষ্ট সতেজ উচ্চারণ, কোথাও কিছুমাত্র জড়িমা নাই, এবং ভাব-প্রকাশের মধ্যে এমন একটা নিঃসংশয় বল যে, শুনিয়া বিনয় প্রত্যাশাতীত আনন্দ লাভ করিল। এই কণ্ঠস্বর তাহার কানে অনেকক্ষণ ধরিয়া বাজিতে লাগিল।

 কবিতা-আবৃত্তিতে ভালো আবৃত্তিকারকের সম্বন্ধে শ্রোতার মনে একটা বিশেষ মোহ উৎপন্ন করে। সেই কবিতার ভাবটি তাহার পাঠককে মহিমা দান করে— সেটা যেন তাহার কণ্ঠস্বর, তাহার মুখশ্রী, তাহার চরিত্রের সঙ্গে জড়িত হইয়া দেখা দেয়। ফুল যেমন গাছের শাখায় তেমনি কবিতাটিও আবৃত্তিকারকের মধ্যে ফুটিয়া উঠিয়া তাহাকে বিশেষ সম্পদ দান করে।

 ললিতাও বিনয়ের কাছে কবিতায় মণ্ডিত হইয়া উঠিতে লাগিল। ললিতা এতদিন তাহার তীব্রতার দ্বারা বিনয়কে অনবরত উত্তেজিত করিয়া রাখিয়াছিল। যেখানে ব্যথা সেইখানেই কেবলই যেমন হাত পড়ে, বিনয়ও তেমনি কয়দিন ললিতার উষ্ণ বাক্য এবং তীক্ষ্ণ হাস্য ছাড়া আর কিছু ভাবিতেই পারে নাই। কেন যে ললিতা এমন করিল, তেমন বলিল, ইহাই তাহাকে বারংবার আলোচনা করিতে হইয়াছে; ললিতার অসন্তোষের রহস্য যতই সে ভেদ করিতে না পারিয়াছে ততই ললিতার চিন্তা তাহার মনকে অধিকার করিয়াছে। হঠাৎ ভোরের বেলা ঘুম হইতে জাগিয়া সে কথা তাহার মনে পড়িয়াছে, পরেশবাবুর বাড়িতে আসিবার সময় প্রত্যহই তাহার মনে বিতর্ক উপস্থিত হইয়াছে আজ না জানি ললিতাকে

২০৩