পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

প্রতিমা।

 তখন আনন্দময়ী সদ্য স্নান করিয়া ঘরের মেঝেয় আসন পাতিয়া স্থির হইয়া বসিয়া ছিলেন, বোধ করি বা মনে মনে জপ করিতেছিলেন। বিনয় তাড়াতাড়ি তাঁহার পায়ের কাছে লুটাইয়া পড়িয়া কহিল, “মা!"

 আনন্দময়ী তাহার অবলুণ্ঠিত মাথায় দুই হাত বুলাইয়া কহিলেন, “বিনয়!"

 মার মতো এমন কণ্ঠস্বর কার আছে! সেই কণ্ঠস্বরেই বিনয়ের সমস্ত শরীরে যেন করুণার স্পর্শ বহিয়া গেল। সে অশ্রুজল কষ্টে রোধ করিয়া মুক্তকণ্ঠে কহিল, “মা, আমার দেরি হয়ে গেছে!"

 আনন্দময়ী কহিলেন, “সব কথা শুনেছি বিনয়!"

 বিনয় চকিত হইয়া কহিল, “সব কথাই শুনেছ!"

 গোরা হাজত হইতেই তাঁহাকে পত্র লিখিয়া উকিলবাবুর হাত দিয়া পাঠাইয়াছিল। সে যে জেলে যাইবে সে কথা সে নিশ্চয় অনুমান করিয়াছিল।

 পত্রের শেষে ছিল—

 “কারাবাসে তোমার গোরার লেশমাত্র ক্ষতি করিতে পারিবে না। কিন্তু তুমি একটুও কষ্ট পাইলে চলিবে না। তোমার দুঃখই আমার দণ্ড, আমাকে আর-কোনো দণ্ড ম্যাজিস্ট্রেটের দিবার সাধ্য নাই। একা তোমার ছেলের কথা ভাবিয়ো না মা, আরো অনেক মায়ের ছেলে বিনা দোষে জেল খাটিয়া থাকে, একবার তাহাদের কষ্টের সমান ক্ষেত্রে দাঁড়াইবার ইচ্ছা হইয়াছে; এই ইচ্ছা এবার যদি পূর্ণ হয় তুমি আমার জন্য ক্ষোভ করিয়ো না।

 “মা, তোমার মনে আছে কি না জানি না, সেবার দুর্ভিক্ষের বছরে আমার রাস্তার ধারের ঘরের টেবিলে আমার টাকার থলিটা রাখিয়া আমি পাঁচ মিনিটের জন্য অন্য ঘরে গিয়াছিলাম। ফিরিয়া আসিয়া দেখি, থলিটা চুরি গিয়াছে। থলিতে আমার স্কলার্‌শিপের জমানো পঁচাশি টাকা ছিল; মনে সংকল্প করিয়াছিলাম আরো কিছু টাকা জমিলে তোমার পা ধোবার জলের জন্য একটি রুপার ঘটি তৈরি করাইয়া দিব। টাকা চুরি গেলে পর যখন

২৫৮