পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বকাবকি করিয়া আনন্দময়ীকে ও নিজেক ভুলাইয়া রাখিতে চেষ্টা করিল। সন্ধ্যার সময় যখন মনকে বাঁধিয়া রাখা দুঃসাধ্য হইত, তখন বিনয় উৎপাত করিয়া আনন্দময়ীকে তাঁহার সকল গৃহকর্ম হইতে ছিনাইয়া লইয়া ঘরের সম্মুখের বারান্দায় মাদুর পাতিয়া বসিত; আনন্দময়ীকে তাঁহার ছেলেবেলার কথা, তাঁহার বাপের বাড়ির গল্প বলাইত; যখন তাঁহার বিবাহ হয় নাই, যখন তিনি তাঁহার অধ্যাপক পিতামহের টোলের ছাত্রদের অত্যন্ত আদরের শিশু ছিলেন, এবং পিতৃহীনা বালিকাকে সকলে মিলিয়া সকল বিষয়েই প্রশ্রয় দিত বলিয়া তাঁহার বিধবা মাতার বিশেষ উদ্‌বেগের কারণ ছিলেন, সেই-সকল দিনের কাহিনী। বিনয় বলিত, “মা, তুমি যে কোনোদিন আমাদের মা ছিলে না সে কথা মনে করলে আমার আশ্চর্য বোধ হয়। আমার বোধ হয় টোলের ছেলেরা তোমাকে তাদের খুব ছোট্টো এতটুকু মা বলেই জানত। দাদামশায়কে বোধ হয় তুমিই মানুষ করবার ভার নিয়েছিলে।”

 একদিন সন্ধ্যাবেলায় মাদুরের উপরে প্রসারিত আনন্দময়ীর দুই পায়ের তলায় মাথা রাখিয়া বিনয় কহিল, “মা, ইচ্ছা করে আমার সমস্ত বিদ্যাবুদ্ধি বিধাতাকে ফিরিয়ে দিয়ে শিশু হয়ে তোমার ঐ কোলে আশ্রয় গ্রহণ করি— কেবল তুমি, সংসারে তুমি ছাড়া আমার আর কিছুই না থাকে।”

 বিনয়ের কণ্ঠে হৃদয়ভারাক্রান্ত একটা ক্লান্তি এমন করিয়া প্রকাশ পাইল যে আনন্দময়ী ব্যথার সঙ্গে বিস্ময় অনুভব করিলেন। তিনি বিনয়ের কাছে সরিয়া বসিয়া আস্তে আস্তে তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিনু, পরেশবাবুদের বাড়ির সব খবর ভালো?”

 এই প্রশ্নে হঠাৎ বিনয় লজ্জিত হইয়া চমকিয়া উঠিল। ভাবিল, “মার কাছে কিছুই লুকানো চলে না, মা আমার অন্তর্যামী।' কুণ্ঠিতস্বরে কহিল, “হাঁ, তাঁরা তো সকলেই ভালো আছেন।”

 আনন্দময়ী কহিলেন, “আমার বড়ো ইচ্ছা করে পরেশবাবুর মেয়েদের সঙ্গে আমার চেনা-পরিচয় হয়। প্রথমে তো তাঁদের উপর গোরার মনের

২৭২