পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

লজ্জিত হইয়া উঠিল। সে নিজের অসম্মতি স্পষ্ট করিয়া প্রকাশ করিতে উদ্যত হইলে মহিম আর অপেক্ষা না করিয়া মনে মনে এই বলিতে বলিতে বাহির হইয়া গেলেন যে, বিমাতা কখনো আপন হয় না।

 মহিম যে এ কথা মনে করিতে পারেন এবং বিমাতা বলিয়া তিনি যে সংসারের বিচারক্ষেত্রে বরাবর আসামী-শ্রেণীতেই ভুক্ত আছেন আনন্দময়ী তাহা জানিতেন। কিন্তু লোকে কী মনে করিবে এ কথা ভাবিয়া চলা তাঁহার অভ্যাসই ছিল না। যেদিন তিনি গোরাকে কোলে তুলিয়া লইয়াছেন সেইদিন হইতেই লোকের আচার, লোকের বিচার হইতে তাঁহার প্রকৃতি একেবারে স্বতন্ত্র হইয়া গেছে। সেদিন হইতে তিনি এমন-সকল আচরণ করিয়া আসিয়াছেন যাহাতে লোকে তাঁহার নিন্দাই করে। তাঁহার জীবনের মর্মস্থানে যে একটি সত্যগোপন তাঁহাকে সর্বদা পীড়া দিতেছে লোকনিন্দায় তাঁহাকে সেই পীড়া হইতে কতকটা পরিমাণে মুক্তি দান করে। লোকে যখন তাঁহাকে খৃস্টান বলিত তিনি গোরাকে কোলে চাপিয়া ধরিয়া বলিতেন— “ভগবান জানেন খৃস্টান বলিলে আমার নিন্দা হয় না।' এমনি করিয়া ক্রমে সকল বিষয়েই লোকের কথা হইতে নিজের ব্যবহারকে বিচ্ছিন্ন করিয়া লওয়া তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ হইয়াছিল। এইজন্য মহিম তাঁহাকে মনে মনে বা প্রকাশ্যে বিমাতা বলিয়া লাঞ্ছিত করিলেও তিনি নিজের পথ হইতে বিচলিত হইতেন না।

 আনন্দময়ী কহিলেন, “বিনু, তুমি পরেশবাবুদের বাড়ি অনেক দিন যাও নি।”

 বিনয় কহিল, “অনেক দিন আর কই হল?”

 আনন্দময়ী। স্টীমার থেকে আসার পরদিন থেকে তো একবারও যাও নি।

 সে তো বেশিদিন নহে। কিন্তু বিনয় জানিত, মাঝে পরেশবাবুর বাড়ি তাহার যাতায়াত এত বাড়িয়াছিল যে আনন্দময়ীর পক্ষেও তাহার দর্শন দুর্লভ হইয়া উঠিয়াছিল। সে হিসাবে পরেশবাবুর বাড়ি অনেক দিন যাওয়া

২৭৭