পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পালকি আসিয়া থামিল। দেখি, মনোরমা হাসিতে হাসিতে আসিয়া আমাকে প্রণাম করিল। আমি বলিলাম, কী মনু, তোদের খবর কী? মনোরমা হাসিমুখে বলিল, খবর না থাকলে বুঝি মার বাড়িতে শুধু শুধু আসতে নেই?

 আমার বেয়ান মন্দ লোক ছিলেন না। তিনি আমাকে বলিয়া পাঠাইলেন, বউমা পুত্রসম্ভাবিতা,সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত তাহার মার কাছে থাকিলেই ভালো। আমি ভাবিলাম, সেই কথাটাই বুঝি সত্য। কিন্তু জামাই যে এই অবস্থাতেই মনোরমাকে মারধোর করিতে আরম্ভ করিয়াছে এবং বিপৎপাতের আশঙ্কাতেই বেয়ান তাঁহার পুত্রবধূকে আমার কাছে পাঠাইয়া দিয়াছেন তাহা আমি জানিতেও পারি নাই। মনু এবং তাহার শাশুড়িতে মিলিয়া আমাকে এমনি করিয়া ভুলাইয়া রাখিল। মেয়েকে আমি নিজের হাতে তেল মাখাইয়া স্নান করাইতে চাহিলে মনোরমা নানা ছুতায় কাটাইয়া দিত; তাহার কোমল অঙ্গে যে-সব আঘাতের দাগ পড়িয়াছিল সে তাহা তাহার মায়ের দৃষ্টির কাছেও প্রকাশ করিতে চাহে নাই।

 জামাই মাঝে মাঝে আসিয়া মনোরমাকে বাড়ি ফিরাইয়া লইয়া যাইবার জন্য গোলমাল করিত। মেয়ে আমার কাছে থাকাতে টাকার আবদার করিতে তাহার ব্যাঘাত ঘটিত। ক্রমে সে বাধাও আর সে মানিল না। টাকার জন্য মনোরমার সামনেই আমার প্রতি উপদ্রব করিতে লাগিল। মনোরমা জেদ করিয়া বলিত—কোনোমতেই টাকা দিতে পারিবে না। কিন্তু আমার বড়ো দুর্বল মন, পাছে জামাই আমার মেয়ের উপর অত্যন্ত বেশি বিরক্ত হইয়া উঠে এই ভয়ে আমি তাহাকে কিছু না দিয়া থাকিতে পারিতাম না।

 মনোরমা একদিন বলিল, মা, তোমার টাকাকড়ি সমস্ত আমিই রাখিব। বলিয়া আমার চাবি ও বাক্স সব দখল করিয়া বসিল। জামাই আসিয়া যখন আমার কাছে আর টাকা পাইবার সুবিধা দেখিল না এবং যখন মনোরমাকে কিছুতেই নরম করিতে পারিল না, তখন সুর ধরিল—মেজোবউকে বাড়িতে লইয়া যাইব। আমি মনোরমাকে বলিতাম, দে মা, ওকে কিছু টাকা

২৯২