পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দিয়াছিলেন।

 বরদাসুন্দরী ফিরিয়া আসিয়া তাঁহার ঘরকন্নার মধ্যে এই একটি অভাবনীয় প্রাদুর্ভাব দেখিয়া একেবারে হাড়ে হাড়ে জ্বলিয়া গেলেন। তিনি পরেশকে খুব তীব্র স্বরেই কহিলেন, “এ আমি পারব না।”

 পরেশ কহিলেন, “তুমি আমাদের সকলকেই সহ্য করতে পারছ, আর ঐ একটি বিধবা অনাথাকে সইতে পারবে না?”

 বরদাসুন্দরী জানিতেন পরেশের কাণ্ডজ্ঞান কিছুমাত্র নাই, সংসারে কিসে সুবিধা ঘটে বা অসুবিধা ঘটে সে সম্বন্ধে তিনি কোনোদিন বিবেচনামাত্র করেন না—হঠাৎ এক-একটা কাণ্ড করিয়া বসেন। তাহার পরে রাগই করো, বকো আর কাঁদো, একেবারে পাষাণের মূর্তির মতো স্থির হইয়া থাকেন। এমন লোকের সঙ্গে কে পারিয়া উঠিবে বলো। প্রয়োজন হইলে যাহার সঙ্গে ঝগড়া করাও অসম্ভব তাহার সঙ্গে ঘর করিতে কোন্‌ স্ত্রীলোক পারে!

 সুচরিতা মনোরমার প্রায় একবয়সী ছিল। হরিমোহিনীর মনে হইতে লাগিল সুচরিতাকে দেখিতেও যেন অনেকটা সেই মনোরমারই মতো; আর স্বভাবটিও তাহার সঙ্গে মিলিয়াছে। তেমনি শান্ত অথচ তেমনি দৃঢ়। হঠাৎ পিছন হইতে তাহাকে দেখিয়া এক-এক সময় হরিমোহিনীর বুকের ভিতরটা যেন চমকিয়া উঠে। এক-এক দিন সন্ধ্যাবেলায় অন্ধকারে তিনি একলা বসিয়া নিঃশব্দে কাঁদিতেছেন, এমন সময় সুচরিতা কাছে আসিলে চোখ বুজিয়া তাহাকে দুই হাতে বুকে চাপিয়া ধরিয়া বলিতেন, “আহা আমার মনে হচ্ছে, যেন আমি তাকেই বুকের মধ্যে পেয়েছি। সে যেতে চায় নি, আমি তাকে জোর করে বিদায় করে দিয়েছি, জগৎ-সংসারে কি কোনো দিন কোনোমতেই আমার সে শাস্তির অবসান হবে না! দণ্ড যা পাবার তা পেয়েছি—এবার সে এসেছে; এই-যে ফিরে এসেছে; তেমনি হাসিমুখ করে ফিরে এসেছে; এই-যে আমার মা, এই-যে আমার মণি, আমার ধন!

 এই বলিয়া সুচরিতার সমস্ত মুখে হাত বুলাইয়া, তাহাকে চুমো খাইয়া,

২৯৯