পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩২

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

লইয়া প্রণাম করিল।

 গোরার মা আনন্দময়ীকে দেখিলে গোরার মা বলিয়া মনে হয় না। তিনি ছিপছিপে পাতলা, আঁটসাট শক্ত; চুল যদি বা কিছু কিছু পাকিয়া থাকে বাহির হইতে দেখা যায় না; হঠাৎ দেখিলে বোধ হয়, তাঁহার বয়স চল্লিশেরও কম। মুখের বেড় অত্যন্ত সুকুমার, নাকের ঠোঁটের চিবুকের ললাটের রেখা কে যেন যত্নে কুঁদিয়া কাটিয়াছে; শরীরের সমস্তই বাহুল্যবর্জিত— মুখে একটি পরিষ্কার ও সতেজ বুদ্ধির ভাব সর্বদাই প্রকাশ পাইতেছে। রঙ শ্যামবর্ণ, গোরার রঙের সঙ্গে তাহার কোনোই তুলনা হয় না। তাঁহাকে দেখিবা মাত্রই একটা জিনিস সকলের চোখে পড়ে— তিনি শাড়ির সঙ্গে শেমিজ পরিয়া থাকেন। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি তখনকার দিনে মেয়েদের জামা বা শেমিজ পরা যদিও নব্যদলে প্রচলিত হইতে আরম্ভ হইয়াছে তবু প্রবীণা গৃহিণীরা তাহাকে নিতান্তই খৃস্টানি বলিয়া অগ্রাহ্য করিতেন। আনন্দময়ীর স্বামী কৃষ্ণদয়ালবাবু কমিসেরিয়েটে কাজ করিতেন, আনন্দময়ী তাঁহার সঙ্গে ছেলেবেলা হইতে পশ্চিমে কাটাইয়াছেন, তাই ভালো করিয়া গা ঢাকিয়া গায়ে কাপড় দেওয়া যে লজ্জা বা পরিহাসের বিষয়, এ সংস্কার তাঁহার মনে স্থান পায় নাই। ঘরদুয়ার মাজিয়া ঘসিয়া ধুইয়া মুছিয়া, রাঁধিয়া বাড়িয়া সেলাই করিয়া, গুনতি করিয়া, হিসাব করিয়া, ঝাড়িয়া, রৌদ্রে দিয়া, আত্মীয়স্বজন- প্রতিবেশীর খবর লইয়া তবু তাঁহার সময় যেন ফুরাইতে চাহে না। শরীরে অসুখ করিলে, তিনি কোনোমতেই তাহাকে আমল দিতে চান না; বলেন, “অসুখে তো আমার কিছু হবে না, কাজ না করতে পেলে বাঁচব কী করে।”

 গোরার মা উপরে আসিয়া কহিলেন, “গোরার গলা যখনই নীচে থেকে শোনা যায় তখনই বুঝতে পারি, বিনু নিশ্চয়ই এসেছে। ক'দিন বাড়ি একেবারে চুপচাপ ছিল— কী হয়েছে বল্ তো বাছা। আসিস নি কেন। অসুখ-বিসুখ করে নি তো?”

 বিনয় কুষ্ঠিত হইয়া কহিল, “না মা, অসুখ— যে বৃষ্টিবাদল!”

 গোরা কহিল, “তাই বই-কি। এর পরে বৃষ্টিবাদল যখন ধরে যাবে

২২