পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আনন্দময়ী যখন তুলিতে আসিলেন তখন গোরার ঘরে বিনয়কে দেখিয়া তিনি আশ্চর্য হইয়া গেলেন। তাড়াতাড়ি তাহার পাশে আসিয়া তাহার গায়ে হাত দিয়া কহিলেন, “বিনয়, কী হয়েছে বিনয়? তোর মুখ অমন সাদা হয়ে গেছে কেন?”

 বিনয় উঠিয়া বসিল; কহিল, “মা, আমি পরেশবাবুদের বাড়িতে প্রথম যখন যাতায়াত করতে আরম্ভ করি, গোরা রাগ করত। তার রাগকে আমি তখন অন্যায় মনে করতুম— কিন্তু অন্যায় তার নয়, আমারই নির্বুদ্ধিতা।”

 আনন্দময়ী একটুখানি হাসিয়া কহিলেন, “তুই যে আমাদের খুব সুবুদ্ধি ছেলে তা আমি বলি নে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তোর বুদ্ধির দোষ কিসে প্রকাশ পেলে?”

 বিনয় কহিল, “মা, আমাদের সমাজ যে একেবারেই ভিন্ন সে কথা আমি একেবারেই বিবেচনা করি নি। ওঁদের বন্ধুত্বে ব্যবহারে দৃষ্টান্তে আমার খুব আনন্দ এবং উপকার বোধ হচ্ছিল, তাতেই আমি আকৃষ্ট হয়েছিলুম, আর-কোনো কথা যে চিন্তা করবার আছে এক মুহূর্তের জন্য সে আমার মনে উদয় হয় নি।”

 আনন্দময়ী কহিলেন, “তোর কথা শুনে এখনো তো আমার মনে উদয় হচ্ছে না।”

 বিনয় কহিল, “মা, তুমি জান না, সমাজে আমি তাঁদের সম্বন্ধে ভারি একটা অশান্তি জাগিয়ে দিয়েছি— লোকে এমন-সব নিন্দা করতে আরম্ভ করেছে যে আমি আর সেখানে—"

 আনন্দময়ী কহিলেন, “গোরা একটা কথা বার বার বলে, সেটা আমার কাছে খুব খাঁটি মনে হয়। সে বলে, যেখানে ভিতরে কোথাও একটা অন্যায় আছে সেখানে বাইরে শান্তি থাকাটাই সকলের চেয়ে অমঙ্গল। ওঁদের সমাজে যদি অশান্তি জেগে থাকে তা হলে তোর অনুতাপ করবার কোনো দরকার দেখি নে, দেখবি তাতে ভালোই হবে। তোর নিজের ব্যবহারটা খাঁটি থাকলেই হল।”

৩৬১