পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভাসাইয়া বিনয়ের হৃদয়ের ডাঙার উপর তুলিয়া দিয়া গেল— ললিতার এই সমাজ হইতে ভাসিয়া আসার মূর্তিটিকে সে আর ঠেকাইয়া রাখিতে পারিল না। তাহার মন কেবলই বলিতে লাগিল, “ললিতা আমার, একলাই আমার!' অন্য কোনোদিন তাহার মন দুর্দাম হইয়া এত জোরে এ কথা বলিতে সাহস করে নাই; আজ বাহিরে যখন এই ধ্বনিটা এমন করিয়া হঠাৎ উঠিল তখন বিনয় কোনোমতেই নিজের মনকে আর “চুপ চুপ' বলিয়া থামাইয়া রাখিতে পারিল না।

 বিনয় এমনি চঞ্চল হইয়া যখন বারান্দায় বেড়াইতেছে এমন সময় দেখিল হারানবাবু রাস্তা দিয়া আসিতেছেন। তৎক্ষণাৎ বুঝিতে পারিল তিনি তাহারই কাছে আসিতেছেন এবং অনামা চিঠিটার পশ্চাতে যে একটা বৃহৎ আলোড়ন আছে তাহাও নিশ্চয় জানিল।

 অন্য দিনের মতো বিনয় তাহার স্বভাবসিদ্ধ প্রগল্‌ভতা প্রকাশ করিল না; সে হারানবাবুকে চৌকিতে বসাইয়া নীরবে তাঁহার কথার প্রতীক্ষা করিয়া রহিল।

 হারানবাবু কহিলেন, “বিনয়বাবু, আপনি তো হিন্দু?”

 বিনয় কহিল, “হাঁ, হিন্দু বৈকি।”

 হারানবাবু কহিলেন, “আমার এ প্রশ্নে রাগ করবেন না। অনেক সময় আমরা চারি দিকের অবস্থা বিবেচনা না করে অন্ধ হয়ে চলি— তাতে সংসারে দুঃখের সৃষ্টি করে। এমন স্থলে, আমরা কী, আমাদের সীমা কোথায়, আমাদের আচরণের ফল কতদূর পর্যন্ত পৌঁছয়, এ-সমস্ত প্রশ্ন যদি কেউ উত্থাপন করে, তবে তা অপ্রিয় হলেও, তাকে বন্ধু বলে মনে জানবেন।”

 বিনয় হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “বৃথা আপনি এতটা ভূমিকা করছেন। অপ্রিয় প্রশ্নে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে আমি যে কোনোপ্রকার অত্যাচার করব আমার সেরকম স্বভাব নয়। আপনি নিরাপদে আমাকে সকলপ্রকার প্রশ্ন করতে পারেন।”

৩৮০