পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪১

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 বিনয়ের আর গোরার বাড়ি যাওয়া হইল না। মনের মধ্যে নানা কথা তোলপাড় করিতে করিতে বিনয় বাসায় ফিরিল। পরদিন অপরাহ্ণে বাসা হইতে বাহির হইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে অবশেষে যখন গোরার বাড়িতে আসিয়া পৌছিল, তখন বর্ষার দীর্ঘ দিন শেষ হইয়া সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হইয়া উঠিয়াছে। গোরা সেই সময় আলোটি জ্বালাইয়া লিখিতে বসিয়াছে।

 গোরা কাগজ হইতে মুখ না তুলিয়াই কহিল, “কী গো বিনয়, হাওয়া কোন্ দিক থেকে বইছে।”

 বিনয় সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া কহিল, “গোরা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি— ভারতবর্ষ তোমার কাছে খুব সত্য? খুব স্পষ্ট? তুমি তত দিনরাত্রি তাকে মনে রাখ, কিন্তু কিরকম করে মনে রাখ।”

 গোরা লেখা ছাড়িয়া কিছুক্ষণ তাহার তীক্ষ দৃষ্টি লইয়া বিনয়ের মুখের দিকে চাহিল— তাহার পরে কলমটা রাখিয়া চৌকির পিঠের দিকে ঠেস দিয়া কহিল, “জাহাজের কাপ্তেন যখন সমুদ্রে পাড়ি দেয় তখন যেমন আহারে- বিহারে কাজে-বিশ্রামে সমুদ্রপারের বন্দরটিকে সে মনের মধ্যে রেখে দেয় আমার ভারতবর্ষকে আমি তেমনি করে মনে রেখেছি।”

 বিনয়। কোথায় তোমার সেই ভারতবর্ষ।

 গোরা বুকে হাত দিয়া কহিল, “আমার এইখানকার কম্পাসটা দিনরাত যেখানে কাঁটা ফিরিয়ে আছে সেইখানে, তোমার মার্শ্‌ম্যান সাহেবের ‘হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়া’র মধ্যে নয়।

 বিনয়। তোমার কাঁটা যে দিকে সে দিকে, কিছু-একটা আছে কি।

 গোরা উত্তেজিত হইয়া কহিল, “আছে না তো কী। আমি পথ ভুলতে পারি, ডুবে মরতে পারি, কিন্তু আমার সেই লক্ষ্মীর বন্দরটি আছে। সেই আমার পূর্ণস্বরূপ ভারতবর্ষ— ধনে পূর্ণ, জ্ঞানে পূর্ণ, ধর্মে পূর্ণ— সে ভারতবর্ষ কোথাও নেই! আছে কেবল চারি দিকের এই মিথ্যেটা। এই তোমার কলকাতা শহর, এই আপিস, এই আদালত, এই গোটাকতক ইটকাঠের

৩১