পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 বিনয় মনে মনে কিছু আহত হইয়া কহিল, “হিঁদুয়ানিকে যেদিন কেবল ছোঁওয়া-খাওয়ার নিরর্থক নিয়ম বলেই জানব সেদিন ব্রাহ্ম বলল, খৃস্টান বলল, মুসলমান বলে, যা হয় একটা-কিছু হব। এখনো হিঁদুয়ানির উপর তত অশ্রদ্ধা হয় নি।”

 বিনয় যখন সুচরিতার বাড়ি হইতে বাহির হইল তখন তাহার মন অত্যন্ত বিকল হইয়া ছিল। সে যেন চারি দিক হইতেই ধাক্কা খাইয়া একটা আশ্রয়হীন শূন্যের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছিল। গোরার পাশে সে আপনার পুরাতন স্থানটি অধিকার করিতে পারিতেছে না, ললিতাও তাহাকে দূরে ঠেলিয়া রাখিতেছে— এমন-কি, হরিমোহিনীর সঙ্গেও তাহার হৃদ্যতার সম্বন্ধ অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বিচ্ছিন্ন হইবার উপক্রম হইয়াছে; এক সময় বরদাসুন্দরী তাহাকে আন্তরিক স্নেহ করিয়াছেন, পরেশবাবু এখনো তাহাকে স্নেহ করেন, কিন্তু স্নেহের পরিবর্তে সে তাঁহাদের ঘরে এমন অশান্তি আনিয়াছে যে সেখানেও তাহার আজ আর স্থান নাই। যাহাদিগকে ভালোবাসে তাহাদের শ্রদ্ধা ও আদরের জন্য বিনয় চিরদিন কাঙাল, নানাপ্রকারে তাহাদের সৌহৃদ্য আকর্ষণ করিবার শক্তিও তাহার যথেষ্ট আছে। সেই বিনয় আজ অকস্মাৎ তাহার স্নেহপ্রীতির চিরাভ্যস্ত কক্ষপথ হইতে এমন করিয়া বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িল কেন, এই কথাই সে নিজের মনে চিন্তা করিতে লাগিল। এই-যে সুচরিতার বাড়ি হইতে বাহির হইল, এখন কোথায় যাইবে তাহা ভাবিয়া পাইতেছে না। এক সময় ছিল যখন কোনো চিন্তা না করিয়া সহজেই সে গোরার বাড়ির পথে চলিয়া যাইত, কিন্তু আজ সেখানে যাওয়া তাহার পক্ষে পূর্বের ন্যায় তেমন স্বাভাবিক নহে; যদি যায় তবে গোরার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া তাহাকে চুপ করিয়া থাকিতে হইবে— সে নীরবতা অত্যন্ত দুঃসহ। এ দিকে পরেশবাবুর বাড়িও তাহার পক্ষে সুগম নহে।

 ‘কেন যে এমন একটা অস্বাভাবিক স্থানে আসিয়া পৌঁছিলাম’ ইহাই চিন্তা করিতে করিতে মাথা হেঁট করিয়া বিনয় ধীরপদে রাস্তা দিয়া চলিতে

৪২২