পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

লাগিল। হেদুয়া পুষ্করিণীর কাছে আসিয়া সেখানে একটা গাছের তলায় সে বসিয়া পড়িল। এ পর্যন্ত তাহার জীবনে ছোটোবড়ো যে-কোনো সমস্যা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করিয়া, তর্ক করিয়া, তাহার মীমাংসা করিয়া লইয়াছে; আজ সে পন্থা নাই, আজ তাহাকে একলাই ভাবিতে হইবে।

 বিনয়ের আত্মবিশ্লেষণশক্তির অভাব নাই। বাহিরের ঘটনার উপরেই সমস্ত দোষ চাপাইয়া নিজে নিষ্কৃতি লওয়া তাহার পক্ষে সহজ নহে। তাই সে একলা বসিয়া বসিয়া নিজেকেই দায়িক করিল। বিনয় মনে মনে কহিল, ‘জিনিসটিও রাখিব মূল্যটিও দিব না এমন চতুরতা পৃথিবীতে খাটে না। একটা-কিছু বাছিয়া লইতে গেলেই অন্যটাকে ত্যাগ করিতেই হয়। যে লোক কোনোটাকেই মনস্থির করিয়া ছাড়িতে পারে না, তাহারই আমার দশা হয়, সমস্তই তাহাকে খেদাইয়া দেয়। পৃথিবীতে যাহারা নিজের জীবনের পথ জোরের সঙ্গে বাছিয়া লইতে পারিয়াছে তাহারাই নিশ্চিন্ত হইয়াছে। যে হতভাগা এ পথও ভালোবাসে ও পথও ভালোবাসে, কোনোটা হইতেই নিজেকে বঞ্চিত করিতে পারে না, সে গম্যস্থান হইতেই বঞ্চিত হয় সে কেবল পথের কুকুরের মতোই ঘুরিয়া বেড়ায়।’

 ব্যাধি নিরূপণ করা কঠিন, কিন্তু নিরূপণ হইলেই যে তাহার প্রতিকার করা সহজ হয় তাহা নহে। বিনয়ের বুঝিবার শক্তি খুব তীক্ষ্ণ, করিবার শক্তিরই অভাব; এইজন্য এ-পর্যন্ত সে নিজের চেয়ে প্রবল ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন বন্ধুর প্রতিই নির্ভর করিয়া আসিয়াছে। অবশেষে অত্যন্ত সংকটের সময় আজ সে হঠাৎ আবিষ্কার করিয়াছে, ইচ্ছাশক্তি নিজের না থাকিলেও ছোটোখাটো প্রয়োজনে ধরে-বরাতে কাজ চালাইয়া লওয়া যায়, কিন্তু আসল দরকারের বেলায় পরের তহবিল লইয়া কোনোমতেই কারবার চলে না।

 সূর্য হেলিয়া পড়িতেই যেখানে ছায়া ছিল সেখানে রৌদ্র আসিয়া পড়িল। তখন তরুতল ছাড়িয়া আবার রাস্তায় বাহির হইল। কিছু দূরে যাইতেই হঠাৎ শুনিল, “বিনয়বাবু। বিনয়বাবু।” পরক্ষণেই সতীশ আসিয়া তাহার হাত

৪২৩