পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ঘরের সম্মুখে আসিতেই বিনয় সে দিকে একবার মুখ না তুলিয়া থাকিতে পারিল না; দেখিল তাঁহার টেবিলের সম্মুখে পরেশবাবু বসিয়া আছেন, কোনো কথা কহিতেছেন কি না বুঝা গেল না; আর ললিতা রাস্তার দিকে পিঠ করিয়া পরেশবাবুর চৌকির কাছে একটি ছোটো বেতের মোড়ার উপর ছাত্রীটির মতো নিস্তব্ধ হইয়া আছে।

 সুচরিতার বাড়ি হইতে ফিরিয়া আসিয়া যে ক্ষোভে ললিতার হৃদয়কে অসহ্যরূপে অশান্ত করিয়া তুলিয়াছিল সে তাহা নিবৃত্ত করিবার আর-কোনো উপায়ই জানিত না, সে তাই আস্তে আস্তে পরেশবাবুর কাছে আসিয়া বসিয়াছিল। পরেশবাবুর মধ্যে এমনি একটি শান্তির আদর্শ ছিল যে, অসহিষ্ণু ললিতা নিজের চাঞ্চল্য দমন করিবার জন্য মাঝে মাঝে তাহার কাছে আসিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত। পরেশবাবু জিজ্ঞাসা করিতেন, “কী ললিতা?” ললিতা কহিত, “কিছু নয় বাবা। তোমার এই ঘরটি বেশ ঠাণ্ডা।”

 আজ ললিতা আহত হৃদয়টি লইয়া তাঁহার কাছে আসিয়াছে, তাহা পরেশবাবু স্পষ্ট বুঝিয়াছিলেন। তাঁহার নিজের মধ্যেও একটি বেদনা প্রচ্ছন্ন হইয়া ছিল। তাই তিনি ধীরে ধীরে এমন একটি কথা পাড়িয়াছিলেন যাহাতে ব্যক্তিগত জীবনের তুচ্ছ সুখদুঃখের ভারকে একেবারে হালকা করিয়া দিতে পারে।

 পিতা ও কন্যার এই বিশুদ্ধ আলোচনার দৃশ্যটি দেখিয়া মুহূর্তের জন্য বিনয়ের গতিরোধ হইয়া গেল— সতীশ কী বলিতেছিল তাহা তাহার কানে গেল না। সতীশ তখন তাহাকে যুদ্ধবিদ্যা সম্বন্ধে একটা অত্যন্ত দুরূহ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছিল। এক দল বাঘকে অনেক দিন ধরিয়া শিক্ষা দিয়া স্বপক্ষের সৈন্যদলের প্রথম সারে রাখিয়া যুদ্ধ করিলে তাহাতে জয়ের সম্ভাবনা বিরূপ, ইহাই তাহার প্রশ্ন ছিল। এতক্ষণ তাহাদের প্রশ্নোত্তর অবাধে চলিয়া আসিতেছিল, হঠাৎ এইবার বাধা পাইয়া সতীশ বিনয়ের মুখের দিকে চাহিল, তাহার পরে বিনয়ের দৃষ্টি লক্ষ্য করিয়া পরেশবাবুর ঘরের দিকে চাহিয়াই সে উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, “ললিতাদিদি, ললিতাদিদি, এই দেখো

৪২৫