পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সরিয়ে রাখো এবং কেবলমাত্র ধর্মের দিকে দৃষ্টি রক্ষা করে নিজের হৃদয়কে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করো, এতে খুশি হবার কি যথার্থ কারণ আছে।”

 ললিতা এখনো চুপ করিয়া রহিল। হারানবাবু মনে করিলেন, খুব কাজ হইতেছে। দ্বিগুণ উৎসাহের সহিত বলিলেন, “দীক্ষা! দীক্ষা যে জীবনের কি পবিত্র মুহূর্ত সে কি আজ আমাকে বলতে হবে! সেই দীক্ষাকে কলুষিত করবে। সুখ সুবিধা বা আসক্তির আকর্ষণে আমরা ব্রাহ্মসমাজে অসত্যকে পথ ছেড়ে দেব— কপটতাকে আদর করে আহ্বান করে আনব। বলো ললিতা, তোমার জীবনের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের এই দুর্গতির ইতিহাস কি চিরদিনের জন্যে জড়িত হয়ে থাকবে।”

 এখনো ললিতা কোনো কথা বলিল না, চৌকির হাতটা মুঠা দিয়া চাপিয়া ধরিয়া স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। হারানবাবু কহিলেন, “আসক্তির ছিদ্র দিয়ে দুর্বলতা যে মানুষকে কিরকম দুর্নিবারভাবে আক্রমণ করে তা অনেক দেখেছি, এবং মানুষের দুর্বলতাকে যে কিরকম করে ক্ষমা করতে হয় তাও আমি জানি, কিন্তু যে দুর্বলতা কেবল নিজের জীবনকে নয়, শতসহস্র লোকের জীবনের আশ্রয়কে একেবারে ভিত্তিতে গিয়ে আঘাত করে, তুমিই বলো, ললিতা, তাকে কি এক মুহূর্তের জন্য ক্ষমা করা যায়। তাকে ক্ষমা করবার অধিকার কি ঈশ্বর আমাদের দিয়েছেন?”

 ললিতা চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া কহিল, “না, না, পানুবাবু, আপনি ক্ষমা করবেন না। আপনার আক্রমণই পৃথিবীসুদ্ধ লোকের অভ্যাস হয়ে গেছে- আপনার ক্ষমা বোধ হয় সকলের পক্ষে একেবারে অসহ্য হবে।”

 এই বলিয়া ঘর ছাড়িয়া ললিতা চলিয়া গেল।

 বরদাসুন্দরী হারানবাবুর কথায় উদ্‌বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। তিনি কোনোমতেই এখন বিনয়কে ছাড়িয়া দিতে পারেন না। তিনি হারানবাবুর কাছে অনেক ব্যর্থ অনুনয় বিনয় করিয়া, অবশেষে ক্রুদ্ধ হইয়া, তাঁহাকে বিদায় দিলেন। তাঁহার মুশকিল হইল এই যে, পরেশবাবুকেও তিনি নিজের পক্ষে পাইলেন না, আবার হারানবাবুকেও না। এমন অভাবনীয় অবস্থা কেহ

৪৩৪