পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শুনাইয়াছে। যদিও সে-সব লেখা তিনি যে সমস্তই ঠিক বুঝিতে পারিতেন তাহা নহে এবং তাহাতে তাঁহার নিদ্রাকর্ষণেরই সুবিধা করিয়া দিত, তবু এটুকু মোটামুটি বুঝিতে পারিতেন যে, শাস্ত্র ও লোকাচারের পক্ষ লইয়া গোরা এখনকার কালের আচারহীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করিতেছে। আধুনিক ইংরেজি-শেখা ছেলের পক্ষে ইহা অপেক্ষা আশ্চর্য এবং ইহা অপেক্ষা গুণের কথা আর কী হইতে পারে! ব্রাহ্মপরিবারের মধ্যে প্রথম যখন বিনয়কে দেখিয়াছিলেন তখন বিনয়ই তাঁহাকে যথেষ্ট তৃপ্তিদান করিয়াছিল। কিন্তু, ক্রমে সেটুকু অভ্যাস হইয়া যাওয়ার পর নিজের বাড়িতে যখন তিনি বিনয়কে দেখিতে লাগিলেন তখন তাহার আচারের ছিদ্রগুলিই তাঁহাকে বেশি করিয়া বাজিতে লাগিল। বিনয়ের উপর তিনি অনেকটা নির্ভর স্থাপন করিয়াছিলেন বলিয়াই তাহার প্রতি ধিক্‌কার তাঁহার প্রতিদিন বাড়িয়া উঠিতেছে। সেই জন্যই অত্যন্ত উৎসুকচিত্তে তিনি গোরার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন।

 গোরার দিকে নেত্রপাত করিয়াই হরিমোহিনী একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেলেন। এই তো ব্রাহ্মণ বটে! যেন একেবারে হোমের আগুন। যেন শুভ্রকায় মহাদেব। তাহার মনে এমন একটি ভক্তির সঞ্চার হইল যে, গোরা যখন তাঁহাকে প্রণাম করিল তখন সে প্রণাম গ্রহণ করিতে হরিমোহিনী কুণ্ঠিত হইয়া উঠিলেন।

 হরিমোহিনী কহিলেন, “তোমার কথা অনেক শুনেছি বাবা। তুমিই গৌর? গৌরই বটে। ওই-যে কীর্তনের গান শুনেছি

চাঁদের অমিয়া-সনে চন্দন বাঁটিয়া গো।
কে মাজিল গোরার দেহখানি—

আজ তাই চক্ষে দেখলুম। কোন্ প্রাণে তোমাকে জেলে দিয়েছিল আমি সেই কথাই ভাবি।”

 গোরা হাসিয়া কহিল, “আপনারা যদি ম্যাজিস্ট্রেট হতেন তা হলে জেলখানায় ইঁদুর-বাদুডের বাসা হত।”

 হরিমোহিনী কহিলেন, “না বাবা, পৃথিবীতে চোর-জুয়াচোরের অভাব

৪৩৯