পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সে ভিতরে রাখিয়া দেয় বলিয়া সে মানুষকে নিতান্ত অকারণে নাকাল করিতে পারে।

 গোরা সুচরিতার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “আমি কাল আসব।”

 সুচরিতা আনতনেত্রে কহিল, “আচ্ছ।”

 গোরা বিদায় লইতে উন্মুখ হইয়া হঠাৎ থামিয়া দাঁড়াইয়া বলিয়া উঠিল, “ভারতবর্ষের সৌরমণ্ডলের মধ্যেই তোমার স্থান- তুমি আমার আপন দেশের কোনো ধূমকেতু এসে তোমাকে যে তার পুচ্ছ দিয়ে ঝেঁটিয়ে নিয়ে শূন্যের মধ্যে চলে যাবে সে কোনোমতেই হতে পারবে না। যেখানে তোমার প্রতিষ্ঠা সেইখানেই তোমাকে দৃঢ় করে প্রতিষ্ঠিত করব, তবে আমি ছাড়ব। সে জায়গায় তোমার সত্য, তোমার ধর্ম, তোমাকে পরিত্যাগ করবে এই কথা এরা তোমাকে বুঝিয়েছে। আমি তোমাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেব, তোমার সত্য, তোমার ধর্ম, কেবল তোমার কিম্বা আর দু-চার জনের মত বা বাক্য নয়; সে চারি দিকের সঙ্গে অসংখ্য প্রাণের সূত্রে জড়িত, তাকে ইচ্ছা করলেই বন থেকে উপড়ে নিয়ে টবের মধ্যে পোঁতা যায় না- যদি তাকে উজ্জ্বল ক’রে সজীব করে রাখতে চাও, যদি তাকে সর্বাঙ্গীণরূপে সার্থক করে তুলতে চাও, তবে তোমার জন্মের বহু পূর্বে যে লোকসমাজের হৃদয়ের মধ্যে তোমার স্থান নির্দিষ্ট হয়ে গেছে সেইখানে তোমাকে আসন নিতেই হবে- কোনোমতেই বলতে পারবে না, আমি ওর পর, ও আমার কেউ নয়। এ কথা যদি বল তবে তোমার সত্য, তোমার ধর্ম, তোমার শক্তি একেবারে ছায়ার মতো ম্লান হয়ে যাবে। ভগবান তোমাকে যে জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছেন সে জায়গা যেমনি হোক, তোমার মত যদি সেখান থেকে তোমাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায়, তবে তাতে করে কখনোই তোমার মতের জয় হবে এই কথাটা আমি তোমাকে নিশ্চয় বুঝিয়ে দেব। আমি কাল আসব।”

 এই বলিয়া গোরা চলিয়া গেল। ঘরের ভিতরকার বাতাস যেন অনেকক্ষণ ধরিয়া কাঁপিতে লাগিল। সুচরিতা মূর্তির মতো নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।

৪৫১