পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

উপরে বাণের মতো আসিয়া পড়িয়া পরস্পর সংঘাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বর্ষণ করিতে লাগিল।

 অবশেষে অনেক ক্ষণ বাগ্‌যুদ্ধের পর বিনয় উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “গোরা, তোমার এবং আমার প্রকৃতির মধ্যে একটা মূলগত প্রভেদ আছে। সেটা এতদিন কোনোমতে চাপা ছিল, যখনই মাথা তুলতে চেয়েছে আমিই তাকে নত করেছি, কেননা আমি জানতুম যেখানে তুমি কোনো পার্থক্য দেখ সেখানে তুমি সন্ধি করতে জান না, একেবারে তলোয়ার হাতে ছুটতে থাক। তাই তোমার বন্ধুত্বকে রক্ষা করতে গিয়ে আমি চিরদিনই নিজের প্রকৃতিকে খর্ব করে এসেছি। আজ বুঝতে পারছি এতে মঙ্গল হয় নি এবং মঙ্গল হতে পারে না।”

 গোরা কহিল, “এখন তোমার অভিপ্রায় কী আমাকে খুলে বলে।”

 বিনয় কহিল, “আজ আমি একলা দাঁড়ালুম। সমাজ ব’লে রাক্ষসের কাছে প্রতিদিন মানুষ-বলি দিয়ে কোনোমতে তাকে ঠাণ্ডা করে রাখতে হবে এবং যেমন করে হোত তারই শাসনপাশ গলায় বেঁধে বেড়াতে হবে, তাতে প্রাণ থাক্‌ আর না থাক্‌, এ আমি কোনোমতেই স্বীকার করতে পারব না।”

 গোরা কহিল, “মহাভারতের সেই ব্রাহ্মণশিশুটির মতো খড়কে নিয়ে বকাসুর বধ করতে বেরবে না কি!”

 বিনয় কহিল, “আমার খড়কেতে বকাসুর মরবে কি না তা জানি নে, কিন্তু আমাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবার অধিকার যে তার আছে এ কথা আমি কোনোমতেই মানব না- যখন সে চিবিয়ে খাচ্ছে তখনো না।”

 গোরা কহিল, “এ-সমস্ত তুমি রূপক দিয়ে কথা বলছ, বোঝা কঠিন হয়ে উঠছে।”

 বিনয় কহিল, “বোঝ তোমার পক্ষে কঠিন নয়, মানাই তোমার পক্ষে কঠিন। মানুষ যেখানে স্বভাবত স্বাধীন, ধর্মত স্বাধীন, আমাদের সমাজ সেখানে তার খাওয়া শোওয়া বসাকেও নিতান্ত অর্থহীন বন্ধনে বেঁধেছে, এ কথা তুমি আমার চেয়ে কম জান তা নয়; কিন্তু এই জবর্দস্তিকে তুমি

৪৭৭