পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দুঃখও পাইবে, কিন্তু বসিয়া থাকিবে না— যাহা উচিত বলিয়া জানিবে তাহার জন্য আত্মসমর্পণ করিবে- এমনি করিয়াই পবিত্রসলিলা সংসারনদীর স্রোত চিরদিন প্রবহমণ হইয়া বিশুদ্ধ থাকিবে। ইহাতে মাঝে মাঝে ক্ষণকালের জন্য তীর ভাঙিয়া ক্ষতি করিতে পারে এই আশঙ্কা করিয়া চিরদিনের জন্য স্রোত বাঁধিয়া দিলে মারীকে আহ্বান করিয়া আনা হইবে, ইহা আমি নিশ্চয় জানি। অতএব যে শক্তি তোমাদিগকে দুর্নিবার বেগে সুখস্বচ্ছতা ও সমাজবিধির বাহিরে আকর্ষণ করিয়া লইয়া চলিয়াছেন তাঁহাকেই ভক্তির সহিত প্রণাম করিয়া তাঁহারই হন্তে তোমাদের দুই জনকে সমর্পণ করিলাম, তিনিই তোমাদের জীবনে সমস্ত নিন্দাগ্লানি ও আত্মীয়বিচ্ছেদকে সার্থক করিয়া তুলুন। তিনিই তোমাদিগকে দুর্গম পথে আহ্বান করিয়াছেন, তিনিই তোমাদিগকে গম্যস্থানে লইয়া যাইবেন।

 গোরা এই চিঠি পড়িয়া কিছু ক্ষণ চুপ করিয়া থাকিলে পর বিনয় কহিল, “পরেশবাবু তাঁর দিক থেকে যেমন সম্মতি দিয়েছেন, তেমনি তোমার দিক থেকেও, গোরা, তোমাকে সম্মতি দিতে হবে।”

 গোরা কহিল, “পরেশবাবু সম্মতি দিতে পারেন, কেননা নদীর যে ধারা কূল ভাঙছে সেই ধারাই তাঁদের। আমি সম্মতি দিতে পারি নে, কেননা আমাদের ধারা কূলকে রক্ষা করে। আমাদের এই কূলে কত শতসহস্র বৎসরের অভ্রভেদী কীর্তি রয়েছে, আমরা কোনোমতেই বলতে পারব না, এখানে প্রকৃতির নিয়মই কাজ করতে থাক্‌। আমাদের কূলকে আমরা পাথর দিয়েই বাঁধিয়ে রাখব— তাতে আমাদের নিন্দাই কর আর যাই কর। এ আমাদের পবিত্র প্রাচীন পুরী- এর উপরে বৎসরে বৎসরে নূতন মাটির পলি পড়বে, আর চাষার দলে লাঙল নিয়ে এর জমি চষবে, এটা আমাদের অভিপ্রেত নয়— তাতে আমাদের যা লোকসান হয় হোক। এ আমাদের বাস করবার, এ চাষ করবার নয়। অতএব তোমাদের কৃষিবিভাগ থেকে আমাদের এই পাথরগুলোকে যখন কঠিন বলে নিন্দা কর তখন তাতে আমরা মর্মান্তিক লজ্জা বোধ করি নে।”

৪৮০