পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 বিনয় কহিল, “অর্থাৎ, সংক্ষেপে, তুমি আমাদের এই বিবাহকে স্বীকার করবে না?”

 গোরা কহিল, “নিশ্চয় করব না।”

 বিনয় কহিল, “এবং—”

 গোরা কহিল, “এবং তোমাদের ত্যাগ করব।”

 বিনয় কহিল, “আমি যদি তোমার মুসলমান বন্ধু হতুম।”

 গোরা কহিল, “তা হলে অন্য কথা হত। গাছের আপন ডাল ভেঙে প’ড়ে যদি পর হয়ে যায় তবে গাছ তাকে কোনোমতেই পূর্বের মতো আপন করে ফিরে নিতে পারে না কিন্তু বাইরে থেকে যে লতা এগিয়ে আসে তাকে সে আশ্রয় দিতে পারে, এমন-কি ঝড়ে ভেঙে পড়লে আবার তাকে তুলে নিতে কোনো বাধা থাকে না। আপন যখন পর হয় তখন তাকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করা ছাড়া অন্য কোনো গতি নেই। সেই জন্যেই তো এত বিধিনিষেধ, এত প্রাণপণ টানাটানি।” .

 বিনয় কহিল, “সেই জন্যেই তো ত্যাগের কারণ অত হালকা এবং ত্যাগের বিধান অত সুলভ হওয়া উচিত ছিল না। হাত ভাঙলে আর জোড়া লাগে। বটে, সেই জন্যেই কথায় কথায় হাত ভাঙেও না। তার হাড় খুব। মজবুত। যে সমাজে অতি সামান্য ঘা লাগলেই বিচ্ছেদ ঘটে এবং সে বিচ্ছেদ চিরবিচ্ছেদ হয়ে দাঁড়ায়, সে সমাজে মানুষের পক্ষে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা কাজকর্ম করার পক্ষে বাধা কত সে কথা কি চিন্তা করে দেখবে না?”

 গোরা কহিল, “সে চিন্তার ভার আমার উপর নেই। সমাজ এমন সমগ্রভাবে এমন বোরকম করে চিন্তা করছে যে আমি টেরও পাচ্ছি নে সে ভাবছে। হাজার-হাজার বৎসর ধরে সে ভেবেছে এবং আপনাকে রক্ষাও করে এসেছে, এই আমার ভরসা। পৃথিবী সূর্যের চারি দিকে বেঁকে চলছে কি সোজা চলছে, ভুল করছে কি করছে না, সে যেমন আমি ভাবি নে এবং না ভেবে আজ পর্যন্ত আমি ঠকি নি— আমার সমাজ সম্বন্ধেও আমার সেই ভাব।”

৩১
৪৮১